ফতে কিছুক্ষণের জন্যে লুনাকে রাখবে ফজলুর কাছে। লুনা খুব স্বাভাবিকভাবেই থাকবে-হইচই করবে না, কান্নাকাটি করবে না। নিজের মনে মুঠি বন্ধ করা এবং মুঠি খোলার খেলা খেলতে থাকবে। লুনাকে রেখে ফতে অতিদ্রুত বাজার শেষ করে বাড়ি ফিরবে। তখন ফতের মামি আতঙ্কিত গলায় ফতেকে জিজ্ঞেস করবেন-লুনা কোথায়। ওকে পাচ্ছি না। ফতে বলবে, আপনার সঙ্গেই তো ছিল। মামি তখন কাঁদো কাঁদো গলায় বলবেন, দেখছি নাতো। ফতে তৎক্ষণাৎ লুনার খোঁজে রাস্তায় বের হবে। চলে যাবে ফজলুর কাছে। সেখান থেকে লুনাকে নিয়ে যাবে বুড়িগঙ্গায়। যে নৌকাটা সে থাকার জন্যে ভাড়া করেছে সেই নৌকায়। আসল ঘটনা নৌকায় ঘটানো হবে।
তারপর সে আবার বাড়ি ফিরে আসবে। ততক্ষণে পুলিশ চলে এসেছে। বাড়িতে কান্নাকাটি হচ্ছে। ফতে আবারো লুনার খোঁজে বের হবে। এবার বের হবে বেবিট্যাক্সি নিয়ে। তার চাদরের নিচে বড় কালো পলিথিনের ব্যাগে সযত্নে রাখা মাথাটা বের করে সে যাত্রীদের সিটের এক কোনায় রেখে দেবে। আসল খেলা শুরু হবে তখন।
লুনা মেয়েটাকে নিয়ে মন খারাপ করার কিছু নেই। এই মেয়েটা বড় হয়ে বাবামার জন্যে যন্ত্রণ ছাড়া কিছু নিয়ে আসবে না। সব যন্ত্রণার সমাধান। এক অর্থে ফতে তার মামা-মামির উপকারই করছে।
পুরো ব্যাপারটা ভাবতে ফতের খুব মজা লাগছে। হাসি চাপিতে পারছে না। চায়ের দোকানি অবাক হয়ে বলল, ভাইজান একলা একলা হাসেন ক্যান?
ফতে হাসি না থামিয়েই বলল, আমার মাথা খারাপ। এই জন্যে একা এক হাসি। দেখি আরেক কাপ চা দেন। চিনি বেশি করে দেবেন। সব পাগল চিনি বেশি খায়।
ফতে শরীর দুলিয়ে শব্দ করে হাসবে। তার কাছে মনে হচ্ছে কালো পলিথিনের ব্যাগে মোড়া জিনিসটা একবার এই দোকানদারকে দেখিয়ে দিলে হয়। এই সব চায়ের দোকান অনেক রাত পৰ্যন্ত খোলা থাকে। রাত একটা দেড়টার দিকে দোকান খোলা থাকার কথা। বেবিট্যাক্সি দোকানোর সামনে রেখে সে চ খেতে আসতে পারে। তখন দোকানিকে বলতে পারে–ভাইসাব আমার বেবিট্যাক্সির সিটে একটা জিনিস আছে। দেখলে মজা পাবেন। দেখে আসেন।
জটিল হইচই
বদরুল সাহেবের বাড়ির সামনে জটিল হইচই হচ্ছে। বদরুল সাহেবের স্ত্রীর তীক্ষ্ণ গলা শোনা যাচ্ছে। মিসির আলি ইয়াসিনকে বললেন, কী হয়েছে রে?
ইয়াসিন বলল, জানি না। মনে হয় চোর ধরছে।
সন্ধ্যার দিকে ঐ বাড়িতে রোজই হইচই হয়। এতে গুরুত্ব দেবার কিছু নেই। কিন্তু মহিলার তীক্ষ্ণ গলার স্বর কানে লাগছে।
মিসির আলি ইয়াসিনের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার জন্যে মাথা ধরার ট্যাবলেট নিয়ে এস। খুব মাথা ধরেছে।
ইয়াসিন বলল, মাথা বানায়া দেই।
মিসির আলি বললেন, মাথা বানাতে হবে না। মাথা বানানোই আছে। তুমি মাথা ধরার ট্যাবলেট কিনে এনে খুব কড়া করে এক কাপ চা বানিয়ে দাও!
ইয়াসিন চলে গেল। তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ফতে ঘরে ঢুকল। মিসির আলির দিকে তাকিয়ে বলল, স্যার আপনার ঘরে কি লুনা লুকিয়ে আছে?
মিসির আলি অবাক হয়ে বললেন, নাতো।
ফতে বলল, মেয়েটারে পাওয়া যাচ্ছে না! চুপিচুপি এসে খাটের নিচে হয়তো লুকিয়ে আছে। স্যার একটু খুঁজে দেখি?
হ্যাঁ দেখ।
ফতে সবগুলি ঘর খুঁজল। বাথরুমে উঁকি দিল। খাটের নিচে দেখল। ফতের সঙ্গে সঙ্গে মিসির আলিও খুঁজলেন।
ফতে বলল, নাহ। এদিকে আসে নাই।
মিসির আলি বললেন, ফতে তোমাকে একটা কথা বলি শোন। তুমি মেয়েটাকে খুঁজতে এসেছ-খাটের নিচে উঁকি দিয়েছ-কিন্তু তুমি কিন্তু মেয়েটাকে খুঁজছিলে না।
ফতে শান্ত গলায় বলল, স্যার এটা কেন বললেন?
মিসির আলি বললেন, আমার খাটের নিচে দুটা বইভর্তি ট্রাংক আছে। সত্যি সত্যি মেয়েটাকে খুঁজলে তুমি অবশ্যই ট্রাংকের ওপাশে কী আছে দেখার চেষ্টা করতে। তা ছাড়া তুমি বাথরুমে উঁকি দিয়েছ? বাথরুমের ভেতরটাও তুমি দেখ নি। বাথরুমের দরজা খুলে তুমি তাকিয়ে ছিলে আমার দিকে।
ফতে বলল, স্যার আপনি ঠিক ধরেছেন। আমি আসলে খুঁজি নাই। কারণ আমি জানি লুনা এই দিকে আসে নাই। সে নিজে নিজে কোনোদিকে যায় না। তার মার মনের শান্তির জন্যে আমি এদিক-ওদিক খোঁজাখুঁজি করতেছি। ছাদে গিয়েছি দুইবার। ছাদের পানির টাংকির মুখ খুলে ভিতরে দেখেছি।
মিসির আলি বললেন, ফতে তুমি একটু বস তো। এই চেয়ারটায় বস।
ফতে বসল।
মিসির আলি বললেন, বাচ্চা একটা মেয়ে পাওয়া যাচ্ছে না। মেয়ের মা কান্নাকাটি করছে–আমি কিন্তু তোমার ভেতর কোনো উত্তেজনা লক্ষ করছি না। তোমাকে খুবই স্বাভাবিক লাগছে।
ফতে বলল, সব মানুষ তো একরকম না। স্যার। আমি যেরকম, আপনি সেরকম না। কিছু কিছু মানুষ উত্তেজিত হলেও বাইরে থেকে বোঝা যায় না। স্যার কী করে বুঝলেন যে আমি খুব স্বাভাবিক আছি? আমার কপাল ঘামে নাই, আমার কথাবার্তা জড়ায়ে যায় নাই এই জন্যে।
না, তা না। তুমি খুব স্বাভাবিক আছ এটা বুঝেছি সম্পূর্ণ অন্য একটা ব্যাপার থেকে। তুমি লেফট হ্যান্ডার। বঁহাতি মানুষ। বঁহাতি মানুষ উত্তেজিত অবস্থায় ডান হাত ব্যবহার করতে শুরু করে। তুমি তা করছ না। তুমি বঁ। হাতই ব্যবহার করছি। অথচ তোমাদের বাড়িতে আজ ভয়ন্ধের ঘটনা ঘটেছে।
ফতে মনে মনে বলল, শাবাশ বেটা। তুই মানুষের মাথার ভিতর ঢুকতে পারিস না। তার পরেও তুই অনেক কিছু বুঝতে পারিস। তোর সাথে পাল্লা দিতে পারলে খারাপ হয় না। আমি তোকে চিনে ফেলেছি, তুই কিন্তু এখনো আমাকে চিনস নাই।