তা হলে কী দাঁড়াচ্ছে মেয়েটা মিসির আলিকে দিয়ে কাগজে লেখার মতো জটিল কাজটি করিয়ে নিয়েছে এমনভাবে যে মিসির আলি কিছু বুঝতেই পারেন নি। যার স্মৃতি পর্যন্ত মস্তিষ্কে নেই। অর্থাৎ মিসির আলির মস্তিষ্কের পুরো নিয়ন্ত্রণ ছিল মেয়েটির কাছে। মেয়েটি কোনো এক অস্বাভাবিক ক্ষমতায় মানুষের মাথার ভেতর সরাসরি ঢুকে যেতে পারছে। এই ক্ষমতা বিজ্ঞান স্বীকার করে না। তবে এ ধরনের ক্ষমতার উল্লেখ বারবারই প্রাচীন সাহিত্যে পাওয়া যায়। পৌরাণিক কাহিনীতে পাওয়া যায়। আমেরিকার ডিউক ইউনিভার্সিটি এই বিষয়ের ওপর দীর্ঘ গবেষণা চালিয়ে প্রমাণ করেছে যে, এই ক্ষমতার কোনো অস্তিত্ব নেই। এটি শুধুমাত্রই লোকজ বিশ্বাস।
মিসির আলি আরেকটা সিগারেট ধরালেন। বুক শেলফ থেকে সাইকোপ্যাথিক মাইন্ড বইটি হাতে নিলেন–কিন্তু পাতা উন্টলেন না। তাঁর স্মৃতিশক্তি আগের মতো নেই–তার পরেও এই বইটির প্রতিটি পাতা তার প্রায় মুখস্থ।
পৃথিবীর ভয়ঙ্কর সব খুনিদের মানসিক ছবি বা সাইকোলজিক্যাল প্ৰফাইল এই বইটিতে দেওয়া আছে। প্রতিটি ভয়ঙ্কর অপরাধীর ক্ষেত্রেই বলা হচ্ছে-অপরাধীর একটি অস্বাভাবিক ক্ষমতার কথা-অন্যকে বশীভূত করার ক্ষমতা।
এই ক্ষমতার উৎস কী? অপরাধী কি অন্যের মাথার ভেতর ঢুকে পড়ছে? তার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিচ্ছে?
এই ক্ষমতা শুধু যে ভয়ঙ্কর অপরাধীদের আছে তা না-মহান সাধুসন্তদেরও আছে বলে বলা হয়ে থাকে। তারাও মানুষের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে পারতেন। একজনের নিয়ন্ত্রণ আলোর দিকে-অন্যজনের নিয়ন্ত্রণ অন্ধকারের দিকে।
স্যার চা খাইবেন?
মিসির আলি চমকে তাকালেন। ইয়াসিন তার দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখের দৃষ্টিটা যেন কেমন। যেন অশুভ কিছু সেখানে আছে।
মিসির আলি বললেন, না চা খাব না। আমি রাস্তায় কিছুক্ষণ হাঁটব।
স্যার অ্যাপনের শইল কি খারাপ? না।
আমার শরীর ভালো।
ফজলু খুব লজ্জিত বোধ করছে। ফতে নামের এমন একজন ভালো মানুষের ব্যাপারে সে এত খারাপ ধারণা করেছিল। ছিঃ ছিঃ ছিঃ! প্রথম থেকেই তার মনে হয়েছিল-লোকটা খারাপ। লোকটার ভেতর মতলব আছে। লোকটার নজর দিলজনের দিকে। লোকটা যখন তাকে সিগারেট দিত–তার কাছে মনে হত সে কোনো মতলবে সিগারেটটা দিচ্ছে। তার নিতে ইচ্ছা করত না, লোভে পড়ে নিত। লোভ খুব খারাপ জিনিস।
ফজলু দিলজনকে বলে দিয়েছে যেন কখনো ফতের কাছে না যায়। ফতে যদি তাকে ডাকে সে যেন ঘরে ঢুকে পড়ে। ফজলু নিশ্চিত ছিল-ফতে দিলজানকে ডাকবে। ফতে ডাকে নি। কোনোদিনও ডাকে নি। তার পরেও ফজলুর সন্দেহ দূর হয় নি। আজ সন্দেহ পুরোপুরি দূর হয়েছে। ফতে তাকে নার্সারিতে কাজ যোগাড় করে দিয়েছে। প্ৰতিদিন তিন ঘণ্টা কাজ করবে। গাছে পানি দেবে-গোবর আর মাটি মিশিয়ে মশলা তৈরি করবে। বিনিময়ে পঞ্চাশ টাকা পাবে।
কাজটা শেখা হয়ে গেলে সে নিজেই একটা নার্সারি দিবে। কোনো একটা রাস্তার ফুটপাত দখল করে বসে পড়বে। সে টাকা জমাতে শুরু করেছে। বন্ধর্কি বসতবাড়ি ছাড়িয়ে এনে স্ত্রী-কন্যাকে গ্রামে পাঠিয়ে দেবে। মেয়ের বিয়ে দেবে।
ফজলু গাঢ় স্বরে বলল, আপনি আমার বড় একটা উপকার করলেন।
ফতে বলল, এটা কোনো উপকার হল নাকি। এটা কোনো উপকারই না। নাও একটা সিগারেট নাও।
ফজলু আনন্দে অভিভূত হয়ে সিগারেট নিল। এমন একটা ভালোমানুষের বিষয়ে সে কী খারাপ ধারণাই না করেছিল। ছিঃ ছিঃ ছিঃ।
ফতে বলল, চা খাবে নাকি? চল এক কাপ চা খাই।
ফজলু বলল, চলেন। চায়ের দাম কিন্তু আমি দিমু। এইটা আমার একটা আবদার।
ফতে চা খাচ্ছে। রাস্তার পাশের দোকানের টুলের উপর সে একা বসে আছে। ফতের এটা দ্বিতীয় কাপ। প্রথম কাপের দাম ফজলু দিয়ে চলে গেছে। দ্বিতীয় কাপে সে একা বসে চুমুক দিচ্ছে।
তার হাতে সময় বেশি নেই। বড় ঘটনা আজ রাতেই ঘটবে। এই ভেবে তার মনে আলাদা কোনো উত্তেজনা নেই বরং শান্তি শান্তি লাগছে। ঘটনাগুলি সে সাজিয়ে রেখেছে। সাজানোর কোনো ভুল নেই। তার পরেও প্রতিটি ঘটনায় একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া দরকার। ঠাণ্ডা মাথায় বিবেচনা করা।
ফতের মাথা ঠাণ্ডাই আছে। যে কোনো বড় ঘটনা ঘটাবার আগে তার মাথা ঠাণ্ডা থাকে। বড় ঘটনা এর আগে সে চারবার ঘটিয়েছে–তিনবার গ্রামে, একবার শহরে। কোনোবারই তার মাথা এলোমেলো ছিল না। চারটা বড় ঘটনার বিষয়ে কেউই কিছু জানে না। এবারো কেউ কিছু জানবে না। এবারেরটা আরো বেশি গোছানো।
আজ বুধবার তার মামি গিয়েছেন তার আদরের বুড়ো ভাইয়ার কাছে। সেই ভাইয়া মনের সুখে পুটুরানী পুটুরানী করে আদর করছে। আদরটাব্দর খেয়ে মামি বাসায় ফিরবে। তার আগেই বাড়ির গেটের কাছে ফতে বসে থাকবে লুনাকে নিয়ে। লুনা তার মাকে দেখে আনন্দে হাততালি দিয়ে বলবে-পুটুরানী পুটুরানী। এটা লুনা বলবে কারণ ফতে তাকে শিখিয়ে দেবে। এই ঘটনার ফলাফল কী হবে। ফতে জানে না। হয়তো মা মেয়েকে চড়ুথাপ্নড় দেবে। কিংবা হাত ধরে মেয়েকে ঘরে নিয়ে যাবে। যাই করুক না কেন ফতের কিছু যায় আসে না। সে জানে মামি তাকে অকারণে কিছুক্ষণ ধমক ধমকি করবে। তারপর পাঠাবে কোনো একটা কিছু দোকান থেকে কিনে আনতে। কাপড় ধোয়ার সাবান, সয়াবিন তেল, কিংবা কাঁচা মরিচ বা ধনেপাতা।
ফতে গায়ে চাদর জড়িয়ে বাজার আনতে যাবে। চাদরের নিচে গুটিসুটি মেরে লুকিয়ে থাকবে লুনা। গেট দিয়ে যখন ফতে বের হবে তখন কেউ বুঝতেও পারবে না, ফতের চাদরের নিচে কী আছে।