তোমাকে নিয়ে যেতে হবে না। তুমি তোমার ঠিকানা রেখে যাও। সাত দিন পর আমি নিজেই উপস্থিত হব।
প্ৰতিমা শান্ত গলায় বলল, না। আমি আপনাকে নিয়ে যাব। ব্যাগ থাকল, আমি উঠলাম। ভুলে যাবেন না, আগামী সোমবার।
ইয়াসিন দরজা ধরে চোখ গোল করে তাকিয়ে আছে। তার দৃষ্টি মিসির আলির দিকে। মানুষটা ছটফট করছে। কেন ছটফট করছে সে বুঝতে পারছে না, তবে তার ধারণা একটু আগে যে মেয়েটা এসেছিল তার সঙ্গে এর কোনো যোগ আছে। ব্যাপারটা ইয়াসিনের ভালো লাগছে না। সে তার ছোট জীবনে লক্ষ করেছে। নিরিবিলি সংসারে কোনো একটা মেয়ে উপস্থিত হলেই সব লণ্ডভণ্ড হতে শুরু করে। তার নিজের বাবার সংসারেও একই ঘটনা ঘটেছে। সে এবং তার বাবা সুখেই ছিল। একসঙ্গে ভিক্ষা করত। রাতে ঘুমানোর জন্যে সুন্দর একটা জায়গাও তাদের ছিল। বাবাকে জড়িয়ে ধরে সে ঘুমোত। বাবা গুটুর গুটুর করে কত মজার গল্প করত। তার বাবার ভিক্ষুক জীবন বড়ই রোমাঞ্চকর। হঠাৎ তাদের সংসারে এক কমবয়সী ভিখারিনি উপস্থিত হল। সেও তাদের সঙ্গে ভিক্ষণ করা শুরু করল। এরপর থেকে বাবা আর তার ছেলেকে দেখতে পারে না। কারণে-অকারণে ধমক। একদিন তাকে এমন এক ধাক্কা দিল যে সে একটু হলেই ট্রাকের নিচে পড়ত।
এই সংসারেও একই ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। মেয়েটা ঢুকে পড়েছে। এখনই কেমন মাতিবরি শুরু করেছে–পানি গরম করে আমাকে ডাকবি। চা বানাবি না। চা আমি এসে বানাব। শখ কত। তুমি চা বানাবে কেন? আমি কি বানাতে পারি না? এই মেয়েকে শিক্ষা দেবার ক্ষমতা ইয়াসিনের আছে। মেয়েকে শিক্ষা দেবার জিনিস তার ব্যাগেই আছে। শিক্ষা দেবার ভয়ঙ্কর জিনিসটা সে আসলে যোগাড় করেছিল তার বাবার সঙ্গে যে মেয়েটা ঘোরে তাকে শিক্ষা দেবার জন্যে। সেই সুযোগ তার খুব ভালোই আছে। বাবা মনে কষ্ট পাবে এমন কাজ ইয়াসিন কোনোদিন করবে না। আসমান থেকে ফেরেশতা নেমেও যদি বলে-ইয়াসিনরে কাজটা করা। তোর আখেরে মঙ্গল হবে। তবু সে কাজটা করবে না। তার বাবার মনে কষ্ট হয় এমন কিছু করা তার পক্ষে সম্ভব না।
মিসির আলি নামের মানুষটার মনে কষ্ট হয় এমন কিছুও সে করতে পারবে না। এই মানুষটাও পেয়ারা মানুষ। তবে প্রতিমা নামের মেয়েটার কিছু হলে মিসির আলির যাবে আসবে না। কারণ উনি মেয়েটাকে পছন্দ করেন না। উনি যে ছটফট করছেন—
মেয়েটার কারণেই ছটফট করছেন। মেয়েটা উনাকে নিয়ে চলে যেতে চাচ্ছে। উনি যেতে চাচ্ছেন না। মেয়েটার ক্ষতি হলে উনি খুশিই হবেন।
ইয়াসিনের ট্র্যাংকে একটা বোতল আছে। বোতলে ভয়ঙ্কর জিনিস আছে। ভয়ঙ্কর জিনিসটা দেখতে পানির মতো। গ্লাসে ঢাললে মনে হবে পানি ঢালা হয়েছে। সেই পানি মুখে দিলে জ্বলোপুড়ে সব ছারখার হয়ে যাবে। জিনিসটার নাম এসিড। এর আরেকটা নাম আছে-ভোম্বল। ভোম্বল নামটা ফিসফিস করে বললেই—যার বোঝার সে বুঝে নেবে।
ইয়াসিন বলল, স্যার চা খাইবেন?
মিসির আলি কিছু বললেন না। ইয়াসিন আবার বলল, স্যার চা খাইবেন?
মিসির আলি সেই প্রশ্নেরও জবাব দিলেন না। ইয়াসিনের মনটা খারাপ হয়ে গেলআহারে লোকটা কী কষ্টে পড়েছে! দুনিয়াদারিই তার মাথায় নাই। লোকটার মাথায় মেয়েটা ঘুরছে। লোকটাকে মেয়ের হাত থেকে বঁচাতে হবে। বাঁচানোর সরঞ্জাম তার হাতেই আছে-এক নম্বুরি ভোম্বল। এই ভোম্বল লোহা হজম করে ফেলে। এই ভোম্বল সহজ, ভোম্বল না।
ইয়াসিন চা বানাতে গেল। মিসির আলি না চাইলেও সে সুন্দর করে চা বানিয়ে সামনে রাখবে। মনে মনে বলবে–এত চিন্তার কিছু নাই। আমি আছি না। আমি একবার যারে ভালো পাই তারে জন্মের মতো ভালো পাই।
মিসির আলি বেতের চেয়ারে বসে আছেন। তাঁর হাতে সিগারেট। সামনে চায়ের কাপ। চায়ের কাপের চা অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে–তিনি খালি কাপেই চুমুক দিচ্ছেন। হাতের সিগারেটের ছাইও সেইখানেই ফেলছেন। তাঁর মুখের কাঠিন্য কমে আসছে। দলিলের রহস্য পরিষ্কার হতে শুরু করেছে। তিনি এগুচ্ছেন। সহজ লজিক দিয়ে। সহজ লজিক তাকে যেখানে পেঁৗছে দিচ্ছে সেই জায়গাটা উঠার পছন্দ না। তিনি এই জায়গাটায় পৌঁছতে চাচ্ছেন না।
মিসির আলি লজিকের সিঁড়িগুলি এইভাবে দাড়া করিয়েছেন—
১. দলিলের লেখাগুলি তার হাতের। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
২. কোনো নেশার কন্তু খাইয়ে ঘোরের মধ্যে এই লেখা আদায় করা হয় নি। কারণ লেখা স্পষ্ট, পরিষ্কার।
৩. মানুষকে হিপনোটাইজ করে কিছু লেখা লেখানো যায়-সেই লেখাও হবে নেশাগ্ৰস্ত মানুষের হাতের লেখার মতো। ছােট কোনো বাক্যও সম্পূর্ণ করা প্রায় অসম্ভব। নেশাগ্ৰস্ত এবং হিপনোটিক ইনফ্লুয়েন্সের লেখা হবে কঁপি কঁপা। এই সময় ভিশন ডিসটন্টেড হয় বলে কেউ সরলরেখা টানতে পারে না, এবং সরলরেখায় লিখতেও পারে না।
কাজেই তিনি দলিলের লেখাগুলি ঠাণ্ডা মাথায় এবং অবশ্যই সূক্ষ্ম মস্তিষ্কে লিখেছেন।
৪. প্রতিমা তাকে দলিল দেখাবার সময় খুব মজা পাচ্ছিল এবং হাসােহাসি করছিল। কাজেই দলিলের ব্যাপারটা মেয়েটার কাছে সিরিয়াস কোনো ব্যাপার না-মজার কোনো খেলা। এই খেলা সে প্রথম খেলছে না। আগেও খেলেছে।
তা হলে ব্যাপার এই দাঁড়াচ্ছে যে মেয়েটি মজা করার জন্যে মিসির আলিকে দিয়ে লেখাগুলি লিখিয়ে নিয়েছে। এবং মেয়েটি জানে এই লেখার বিষয় মিসির আলির মনে নেই। মনে থাকলে তো খেলাটার মজা থাকত না।