বল কী?
প্রতিমা খিলখিল করে হাসছে। মনে হচ্ছে সে খুবই মজা পাচ্ছে। মেয়েটার হাসি শুনে মিসির আলির বুক ধড়ফড় করতে লাগল। এই মেয়ে হাসি দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে সে যা করবে বলছে তা সে করবে।
প্রতিমা গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, স্যার শুনুন–আপনার শোবার ঘরে যেখানে আপনার বিছানা করেছি। সেখানে বিশাল একটা জানালা আছে। আপনি সরক্ষণ অরকাশ দেখতে পারবেন।
আমি সারাক্ষণ আকাশ দেখতে চাই এটা তোমাকে কে বলল?
কেউ বলে নি। আমি জানি। আপনার একটা ইচ্ছা হল-মৃত্যুর সময় আপনি আকাশ দেখতে দেখতে মারা যাবেন।
আমি আকাশ দেখে মক্কাতে চাই তোমাকে কে বলল?
কেউ বলে নি। আমি বুঝতে পেরেছি।
মিসির আলি অবাক হয়ে বললেন, কীভাবে বুঝতে পেরেছ?
প্রতিমা হতাশ গলায় বলল, স্যার আপনার হয়েছে কী? আমি যে মনের কথা বুঝতে পারি আপনি তো সেটা জানেন। খুব ভালো করে জানেন। এই নিয়ে আপনি অনেক পরীক্ষাটরীক্ষাও করেছেন–এখন মনে করতে পারছেন না কেন?
বুঝতে পারছি না, কেন মনে করতে পারছি না।
আপনার কি আলজেমিয়ারস ডিজিজ হয়েছে? আমার ধারণা তাই হয়েছে। নেপাল থেকে আমি আপনাকে পশমি চাদর এনে দিলাম। আপনাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিলাম–সব সময় এই চাদর ব্যবহার করবেন। আপনি ঠিকই এই চাদর ব্যবহার করছেন। কিন্তু আমি যে চাদরটা দিয়েছি। এটা ভুল মেরে বসে আছেন। কেন স্যার?
মিসির আলি জবাব দিলেন না। মেয়েটা সত্যি কথাই বলছে-এর বিষয়ে তার কিছুই মনে নেই। মেয়েটি সম্পর্কে যাবতীয় স্মৃতি মস্তিষ্ক মুছে ফেলেছে। ব্যাপারটা রহস্যময়। প্রতিমা সম্পর্কে জানার জন্যে তিনি তাঁর পুরোনো ফাইল ঘেঁটেছেন। প্রতিটি কেইস হিস্ট্রির ফাইল তার আলাদা করা। সেখানে প্ৰতিমার কেইস হিস্ট্রি থাকার কথা—অথচ নেই। পাঁচটি পাতা ফাইল থেকে ছেঁড়া হয়েছে। যে ছিঁড়েছে সে যে খুব সাবধানে গুছিয়ে ছিঁড়েছে তাও না—টেনে ছিঁড়েছে।
প্রতিমা বলল, স্যার এই মুহূর্তে আপনি কী ভাবছেন বলি?
বল।
এই মুহুর্তে আপনি ভাবছেন-পাতাগুলি কে ছিঁড়ল?
মিসির আলি চমকে উঠলেন। প্রতিমা হাসতে হাসতে বলল, আপনি এত চমকে গেলেন কেন? আমি যে মানের কথা ধরতে পারি। তার প্রমাণ অনেকবার আপনাকে দিয়েছি। অথচ আপনি এমনভাবে চমকেছেন যেন প্রথমবার দেখলেন।
ইয়াসিন দু কাপ চা নিয়ে ঢুকেছে। প্রতিমা তার দিকে তাকিয়ে বিরক্ত গলায় বলল, তুমি চা বানিয়ে নিয়ে এসেছি কেন? আমি না তোমাকে বললাম তুমি পানি গরম করে আমাকে খবর দেবে আমি চা বানিয়ে দেব। কি বলি নি?
বলছেন।
আর কখনো এই ভুল করবে না।
ইয়াসিন মুখ ভোঁতা করে দাঁড়িয়ে রইল। প্রতিমা কড়া গলায় বলল, যা হাঁদারামের মতো দাঁড়িয়ে থাকবি না।
ইয়াসিন চলে গেল। প্রতিমা এমনভাবে কথা বলছে যেন সে এ বাড়ির কান্ত্রী। বাড়ির দেখাশোনা, সংসার চালানোর সব দায়িত্ব তার একার। মিসির আলি চায়ে চুমুক দিলেন। প্রতিমা বলল, স্যার আপনি কি নিজের হাতের লেখা চিনতে পারবেন? নাকি নিজের হাতের লেখাও ভুলে গেছেন।
মিসির আলি বললেন, হাতের লেখা চিনব।
পঞ্চাশ টাকার স্ট্যাম্পে আপনাকে দিয়ে কিছু কথা লিখিয়ে নিয়েছিলাম। মনে আছে?
দলিল সঙ্গে নিয়ে এসেছি। চা শেষ করে দলিলটা দেখুন। চা খেতে খেতে দলিল দেখলে সমস্যা আছে।
কী সমস্যা?
আপনি বিষম খাবেন। চা শ্বাসনালি দিয়ে ঢুকে সমস্যা তৈরি করবে।
ভয়ঙ্কর কিছু কি লিখেছি?
আপনার কাছে ভয়ঙ্কর মনে হতে পারে। নিন দেখুন। শুধু পড়ার সময় চায়ে চুমুক দেবেন না।
মিসির আলি দলিল পড়ছেন। হাতের লেখা তার। কালির কলমে লেখা। লেখা দেখে কোন কলামটা ব্যবহার করেছেন সেটাও মনে পড়েছে। ওয়াটারম্যান কলম। ইয়াসিনের আগে যে ছেলেটা কাজ করত। সে অনেক জিনিসপত্রের সঙ্গে তার এই শখের কলামটাও চুরি করে নিয়ে যায়। দলিলে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা–
আমি মিসির অ্যালি
সজ্ঞানে, সুস্থ মস্তিষ্কে নিম্নলিখিত অঙ্গীকার করছি।
ক. আমার চিকিৎসাধীন রোগী প্রতিমার (ভালো নাম আফরোজা বানু) সঙ্গে জীবনের একটি অংশ কাটবে। সে যখন আমাকে তার সঙ্গে থাকতে ডাকবে তখনই আমি তাতে রাজি হব।
খ. প্রতিমার (আফরোজা বানু) সঙ্গে বিবাহ নামক সামাজিক প্রথার ভেতর দিয়ে যেতেও আমার কোনো আপত্তি নেই।
অস্বীকারনামার শেষে ইংরেজি ও বাংলায় মিসির আলির দস্তখত। তারিখ দেওয়া আছে। ছবছর আগের একটা তারিখ।
প্রতিমা দলিলটা মিসির আলির হাত থেকে নিয়ে তার হ্যান্ডব্যাগে রাখতে রাখতে বলল-দলিল পড়ে। আপনি কি চমকেছেন?
মিসির আলি জবাব দিলেন না।
প্ৰতিমা বলল, দলিলটা যে আপনার হাতেই লেখা, এ বিষয়ে কি আপনার কোনো সন্দেহ আছে?
মিসির আলি বললেন, সন্দেহ নেই।
প্রতিমা মিটমিটি হাসতে হাসতে বলল, তা হলে কী দাঁড়াচ্ছে-আপনি আমার সঙ্গে যাচ্ছেন? এই মুহুর্তে আমি আপনাকে বিয়ের জন্যে চাপ দেব না! একসঙ্গে এতটা টেনশন আপনার সহ্য হবে না। আপাতত আমার সঙ্গে থাকলেই হবে।
মিসির আলি চুপ করে রইলেন।
প্রতিমা বলল-কথা বলুন। মুখ পুরোপুরি সিল করে রাখলে হবে কীভাবে? বইগুলি বের করে দিন, আমি ব্যাগে গুছাতে থাকি।
মিসির আলি বললেন, আমাকে কিছু দিন সময় দাও।
প্রতিমা শান্ত গলায় বলল, কতদিন সময় চান?
সাত দিন।
সাত দিন সময় চাচ্ছেন কী জন্যে?
চিন্তা করার জন্যে।
কী চিন্তা করবেন?
আমি আমার মতো করে চিন্তা করব।
ঠিক আছে সাত দিন চিন্তা করুন। সাত দিন পর আমি এসে আপনাকে নিয়ে शांद!