ফতের মাঝে মাঝে ইচ্ছা করেছে বুড়োর কথা বলে হঠাৎ সে তার মামিকে চমকে দেয়। যেমন সে খুব সহজ গলায় বলল, মামি বুধবার যে আপনার বড়দার কাছে যাওয়ার কথা, আপনি যাবেন না?
এটা করা ঠিক হবে না। তখন তার আশ্ৰয় নষ্ট হয়ে যাবে। মামি তৎক্ষণাৎ তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেবেন। তবে এখন যদি সে চায় তা হলে এই কাজটা করতে পারে। এখন বাড়ি থেকে বের করে দিলেও তার থাকার জায়গা আছে। সাজঘরে বিছানা পেতে শুয়ে থাকবে। এখন পুটুরানীর বিষয়টা নিয়ে মজা করা যায়। মজাটা এমনভাবে করা যেন কেউ ধরতে না পারে মজার পেছনে সে আছে।
ফতের আবার বাজারে যেতে হচ্ছে। গরম মশলা এনে বাসায় ঢ়োক মাত্র মামি বললেন, টক দই আন নি কেন? তিনটা মাত্র জিনিস আনতে পাঠালাম এর মধ্যে একটা ভুলে গেলে। তখন ফতে যদি বলে, টক দইয়ের কথা। আপনি বলেন নি তা হলে মামি খুবই রেগে যাবেন! আবার ফতে যদি নিজ থেকে টক দই নিয়ে আসে তা হলেও মামি রাগ করবেন। গলার রগ ফুলিয়ে বলবেন, আগবাড়িয়ে তোমাকে কে দই আনতে বলেছে? সব সময় মাতন্ত্বরি কর কেন? আলগা মাতব্বরি করবে না।
বাজারে যাবার সময় ফতে দেখল-সিঁড়ির গোড়ায় লুনা বসে আছে। একা একা খেলছে। হাতের আঙুল একবার খুলছে একবার বন্ধ করছে। এটা লুনার বিশেষ ধরনের খেলা এবং খুবই পছন্দের খেলাটা সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা খেলতে পারে।ফতে তার কাছে এগিয়ে বলল-পুঁটুরানী পুটুরানী।
লুনা চোখ তুলে তাকাল। মিষ্টি করে হাসল। ফতে তার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল-পুঁটুরানী, পুটুরানী, পুটুরানী।
এইবার লুনা ফিসফিস করে বলল, পুটুরানী।
ফতে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। কাজ হয়েছে। এখন লুনা নিজের মনেই পুটুরানী পুঁটুরানী করতে থাকবে। ফতের মামি ব্যাপারটা খুব সহজভাবে নিতে পারবেন না। লুনার কপালে আজ দুঃখ আছে। চড়থাপ্নড় অবশ্যই খাবে। ভাবতেই ফতের মজা লাগছে। লুনার চড়থাপ্লড়ের চেয়ে মজার দৃশ্য হবে পুটুরানী পুটুরানী শুনে তসলিমা খানম কী করেন সেটা। এই মজার দৃশ্য ফতে দেখতে পাবে না। কী আফসোস!
স্যার কেমন আছেন
স্যার কেমন আছেন?
প্রশ্নের জবাব দেবার আগে মিসির আলি দেয়ালঘড়ির দিকে তাকালেন। সকাল নটা। দেয়ালঘড়িটা আধুনিক ইলেকট্রিক্যাল ঘড়ি না হয়ে পুরোনো দিনের পেন্ডুলাম ঘড়ি হলে ঢং ঢেং করে নটা ঘণ্টা বাজাতে শুরু করত। মিসির আলি শুকনো গলায় বললেন, ভালো আছি। প্রতিমা তুমি কেমন আছ?
ফাক নাম তা হলে মনে আছে। আমি ভাবলাম আবার বোধহয় প্রথম থেকে শুরু করতে হবে। আমার পরিচয় দিতে হবে। কেন আমার নাম প্ৰতিমা ব্যাখ্যা করতে হবে।
মিসির আলি মনে মনে ভাবলেন-মেয়েটা আগে এত কথা বলত না। এখন বলছে কেন?
প্রতিমা বলল, স্যার এখন বলুন আমাকে দেখে কি রাগ লাগছে?
না।
বিরক্তি লাগছে।
বুঝতে পারছি না।
প্রতিমা বলল, আমাকে দেখে আসলে আপনি খুশি হয়েছেন। আপনি বুঝানোর চেষ্টা করছেন যে বিরক্ত হয়েছেন–আসলে তা-না। স্যার ঠিক বলেছি?
আনন্দে এবং উৎসাহে প্রতিমা ঝলমল করছে। আজ তাকে আরো সুন্দর লাগছে। মিসির আলি তাকিয়ে দেখলেন। বসার ঘরে দুটা বড় বড় সুটকেস। এই সুটকেস প্রতিমাই নিয়ে এসেছে। সুটকেস কেন এনেছে কে জানে। মিসির আলি বললেন, যেদিন আসার কথা ছিল সেদিন আস নি। আস নি কেন?
প্রতিমা বলল, আপনি বলুন কেন আসি নি। আপনি হচ্ছেন্ন দ্য গ্রেট মিসির আলি। আমার দিকে তাকিয়েই আপনার বলে দেওয়া উচিত কেন আসি নি। বসার ঘরে দুটা সুটকেস, কেন এনেছি বলুন তো? দেখব। আপনি আগের মিসির আলি আছেন না বয়স হবার কারণে আপনার আগের ডিটেকটিভ ক্ষমতা কমে গেছে।
মিসির আলি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, তুমি ছটফট করছ, কেন? বস।
প্রতিমা বলল, আপনিইবা আমাকে দেখে এত অস্থির হচ্ছেন কেন? আপনিও বসুন।
মিসির আলি বসলেন। প্ৰতিমা বলল-আমি বলেছিলাম নটার সময় আসব। আমি ঠিকই এসেছিলাম। নটা বাজার আগেই গেটের কাছে এসে দাঁড়িয়েছিলাম। ঠিক নটার সময় ঢুকব এই হচ্ছে আমার প্ল্যান। নটা বাজতেই প্ল্যান বদলালাম। ঠিক করলামআপনার কাছে যাব না, যাতে সারা দিন আপনি মনে মনে অপেক্ষা করেন। তাই করেছিলেন না?
হ্যাঁ।
তার পরদিন এলাম না। তার পরদিনও না। এটা করলাম-যাতে অপেক্ষা করতে করতে আপনি ক্লান্ত হয়ে পড়েন। বলুন আপনি ক্লান্ত হয়েছেন না?
খানিকটা হয়েছি।
এবং একসময় আপনার নিশ্চয়ই মনে হওয়া শুরু হয়েছে–আচ্ছা মেয়েটা আসছে। না কেন-ওর কী হয়েছে। বলুন। এ রকম হয়েছে না?
হ্যাঁ হয়েছে।
আমি এই অবস্থাটা আপনার ভেতর তৈরি করার চেষ্টা করেছি। সত্যি করে বলুন, পেরেছি কি না।
হ্যাঁ পেরেছি।
প্রতিমা হাসি হাসি মুখে বলল-ঐ দিন আমার ওপর আপনি খুবই বিরক্ত হচ্ছিলেন। আমি আপনাকে আমার বাড়িতে নিয়ে যাব এটা ভেবে আপনি আতঙ্কে অস্থির হয়েছিলেন। আমার খুবই খারাপ লেগেছিল। তখনই ঠিক করেছিলাম আমি এমন অবস্থা তৈরি করব যাতে আপনি খুব আগ্রহ নিয়েই আমার সঙ্গে থাকতে আসেন।
তোমার কি ধারণা সে রকম অবস্থা তৈরি করতে পেরেছ?
না এখনো পারি নি। তবে এখন আর আপনি আমাকে আগের মতো অপছন্দ করছেন না।
সুটকেসে কী?
সুটকেসে কিছু না। খালি সুটকেস। আপনার বইগুলি আজ। আমি সুটকেসে ভরে সঙ্গে করে নিয়ে যাব। প্রথম দিন বই, তারপর জামাকাপড়, তারপর বাসনকোসন এইভাবে ঘর খালি করব। সব শেষের দিন। আপনি যাবেন! আমি আপনাকে নিয়ে যাব না, আপনি নিজ থেকে যাবেন।