ফতে বেবিট্যাক্সি বাড়ি পর্যন্ত নিল না, বাড়ির কাছাকাছি এসে ছেড়ে দিল। বেবিট্যাক্সিওয়ালাকে বাড়ি চেন্নানো মোটেই ঠিক হবে না। কেন সে মুরপির মাথা সিটে রেখেছে তা নিয়ে দরবার করতে পারে। এই সব সূক্ষ্ম কাজ খুব ঠাণ্ডা মাথায় করতে হয়। সামান্য উনিশ-বিশও করা যায় না। ফতে এই কাজগুলি ঠাণ্ডা মাথায় করে বলেই এখনো টিকে আছে। কেউ তাকে ধরতে পারে নি। কোনোদিন পারকেও না।
চারটা মুরগি নিয়ে ফতে রওনা হয়েছে। তার বেশ মজা লাগছে। সে কল্পনায় দেখতে পাচ্ছে তার পরে বেবিট্যাক্সিতে যে উঠবে তার দশটা কী হবে। ধরা যাক স্বামীস্ত্রী উঠেছে। প্রথমে উঠল। স্ত্রী। সে বসতে গিয়ে বলল, কিসের ওপর বসলাম গো? স্বামী বলল, তুমি সব সময় যন্ত্রণা কর! স্ত্রী বলল, হাতে যেন রসের মতো কী লাগল। এর মধ্যে স্বামী এসে উঠেছে। দেয়াশলাই জ্বালিয়ে আঁতকে উঠেছে-হতভম্ব গলায় বলছে সর্বনাশ শত শত মুরগির মাথা। কোত্থেকে আসল?
চারটা মুরগির মাথাই তখন তাদের কাছে শত শত মুরগির মাথা বলে মনে হবে। ভয় পেলে এ রকম হয়।
ফতে ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে ভাবল মুরগির মাথা না হয়ে যদি মানুষের মাথা হত তখন কেমন হত! চারটা মাথার তখন প্রয়োজন নেই। একটা কাটা মাথাই যথেষ্ট। সিটের এক কোনায় কাটা মাথাটা পড়ে আছে। অন্ধকার বলে সবকিছু পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। যাত্রী উঠিল। বেবিট্যাক্সি চলা শুরু করেছে। যাত্রী বলল, কে যেন ব্যাগ নাকি ফেলে গেছে। বলেই সে হাত দিয়ে জিনিসটা তুলল। এরপর যে নাটক হবে তার কোনো তুলনা নেই। এই নাটক কল্পনায় দেখলে হবে না। এই নাটক দেখতে হবে বাস্তবে। বেবিট্যাক্সি নিয়ে ফতেকেই বের হতে হবে। যাত্রী যখন কাটা মাথাটা হাত দিয়ে তুলে ধরে হতভম্ব গলায় বলবে—এটা কী? তখন ফতে খুব স্বাভাবিক গলায় বলবে, এটা একটা ছোট বাচ্চার কাটা মাথা। সাইডে রেখে দেন।
ভাবতেই গা যেন কেমন করছে। মেরুদণ্ড দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে যাচ্ছে। শরীর ঝলমল করছে।
কাজটা করতে হবে। একটা কাটা মাথা নিয়ে বের হতে পারলে অনেক মজা করা যাবে। হয়তো আত্মভোলা টাইপ কোনো যাত্রী উঠেছে। সিটের কোনায় কী পড়ে আছে সে তাকিয়েও দেখছে না। তাকে সে বলল, স্যার সিটের কোনায় ছোট বাচ্চার একটা কাটা মাথা আছে! একটু খেয়াল রাখবেন মাথাটা যেন পড়ে না যায়।
কিংবা ধরা যাক খুব সাহসী কোনো যাত্রী এসেছে। সে প্রচণ্ড ধমক দিয়ে বলল, এই বেবি থামাও। গাড়ির ভেতর মানুষের মাথা কেন? কোত্থেকে এসেছে। চল থানায় চল।
সে তখন খুবই বিনীত গলায় বলবে, মাথাটা স্যার আমি এনেছি। শুক্রবাদ থেকে আরেকটা মাথা তুলে ডেলিভারি দিতে হবে। মাল দুটা ডেলিভারি দিয়ে আপনার সঙ্গে থানায় যাব। কোনো সমস্যা নেই।
ফতের চোখ চকচক করছে। কল্পনা করতেই এত আনন্দ। আসল ঘটনার সময় নাজানি কত আনন্দ হবে।
আসল ঘটনার খুব দেরিও নেই। নকল ঘটনা ঘটতে ঘটতে আসল ঘটনা ঘটে। তার জীবনে সব সময় এ রকমই হয়েছে। অতীতে যেহেতু হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে। কোনো এক বর্ষার রাতে দেখা যাবে মাফলার দিয়ে নাক-মুখ ঢেকে সে বেবিট্যাক্সি নিয়ে বের হয়েছে। সেই বেবিট্যাক্সির প্রাইভেট লেখা সাইনবোর্ড সে খুলে ফেলেছে। এখন তারটা সাধারণ ভাড়ার বেবিট্যাক্সি। ফার্মগেট থেকে যাত্রী তুলেছে, যাবে উত্তরায়। মোটামুটি ফাঁকা রাস্তা। স্বামী-স্ত্রী এবং ছোট একটা বাচ্চা। বাচ্চাটাই প্রথম দেখল। সহজ, গলায় মাকে বলল-মা এটা কী?
ফতের মামি তসলিমা খানম ফতেকে দেখেই রেগে উঠলেন। ক্ষিপ্ত গলায় বললেন, চারটা মুরগি কিনতে এতক্ষণ লাগে? তুমি কি ডিমে তা দিয়ে মুরগি ফুটিয়ে এনেছ?
ফতে কিছু বলল না। বলার কিছু নেই। সে যদি পাঁচ মিনিটের মধ্যে চলে আসত–তা হলেও তসলিমা খানম চোঁচামেচি করতেন। অন্য কোনো প্ৰসঙ্গ নিয়ে চোঁচামেচি। তখন হয়তো বলতেন-বুড়া মোরগ কোত্থেকে এনেছি? এটা কি রোষ্টের মুরগির সাইজ। রোষ্টের মুরগির যে মিডিয়াম সাইজ হয় তুমি জান না। নাকি জীবনে কখনো রোষ্ট খাও নি। তোমাকে কি রোষ্ট কোনোদিন দেওয়া হয় না। আবার বেয়াদবের মতো চোখে চোখে তাকিয়ে আছ কেন?
মামির চোঁচামেচিকে ফতে গ্রাহ্য করে না। কিন্তু ভাব করে যেন খুব গ্রাহ্য করছে। ভয়ে বুক কাঁপছে। এই অভিনয় সে ভালোই করে শুধু একটাই সমস্যা তাকে তাকিয়ে থাকতে হয়। চোখের দিকে না তাকালে সে মাথার ভেতর ঢুকতে পারে না। সমস্যা হচ্ছে চোখের দিকে তাকালেই লোকজন মনে করে সে বেয়াদবি করছে।
তসলিমা খানমের মাথার ভেতর ঢোকা ফতের জন্যে খুব সহজ। হুট করে ঢুকে যাওয়া যায়। তবে খুব সাধারণ একটা মাথা। ঢুকে কোনো আনন্দ নেই। এই মহিলার সমস্ত চিন্তাভাবনা সংসার নিয়ে। আজ কী রান্না হবে। ঘর কোথায় নোংরা। ধোপাখানা থেকে কাপড় আনতে হবে। সবুজ রঙের বিছানার চাদরটা কি শেষ পর্যন্ত হারিয়ে গেল। কাজের বুয়া চুরি করে নি তো। এই মহিলার চিন্তাভাবনার মধ্যে শুধু একটাই মজার ব্যাপার আছে–খায়রুল কবির নামের একজন আধাবুড়ো মানুষ। এই আধাবুড়ো লোকটাকে এই মহিলা ডাকেন—বড়দা। আধাবুড়োটা তাকে ডাকে পুটুরানী। আধাবুড়ো শয়তানটা বিয়ে করে নি। সে বাসাবের একটা দোতলা বাড়িতে থাকে। ফতে কোনোদিন সে বাড়িতে যায় নি। তবে বাড়িটা কোথায়, কেমন সব জানে। কোন ঘরে কী ফার্নিচার তাও সে বলতে পারবে। কারণ ঐ বাড়িটা তসলিমা খানমের মাথায় খুব পরিষ্কারভাবে আছে। তসলিমা খানম স্কুলে পড়ার সময় থেকে ঐ বাড়িতে যেতেন। বিয়ের পরেও যান। আধাবুড়ো শয়তানটা তখন তাকে পুটুরানী, পুটুরানী করে খুবই নোংরাভাবে আদর করা শুরু করে। একসময় পুটুরানী বলে, বড়দা এ রকম করলে আমি কিন্তু আর আসব না। তুমি একা একা থাক বলে মাঝে মাঝে তোমাকে দেখতে আসি, তুমি এসব কী করা। বুড়োটা বলে-আচ্ছা যা আর আসতে হবে না। পুটুরানী তখন বলে, দরজাটা বন্ধ করা। দরজা তো খোলা। বুড়োটা বলে, তোর বন্ধ করতে ইচ্ছা হলে তুই কর। পুটুরানী বলে, কে না কে দেখবে। বুড়ো বলে, দেখুক যার ইচ্ছা।