পর্যন্ত উপদেশমূলক বক্তৃতায় কোনো লাভ হবে। ইয়াসিনের প্রধান ঝোঁক ভিক্ষার দিকে। মিসির আলি নিশ্চিত আজ সে ভিক্ষা করার জন্যই যাচ্ছে। বিষুদবার রাতে বাবার সঙ্গে সে আজমপুর গোরস্থানের গেটে ভিক্ষা করতে যায়।
মিসির আলি বললেন, ভিক্ষা করতে যাচ্ছিস?
ইয়াসিন জবাব দিল না। উদাস দৃষ্টিতে তাকাল।
সকালে কখন আসবি?
দেখি।
সকাল দশটার পরে এলে কিন্তু ঘরে ঢুকতে পারবি না। আমি তালা দিয়ে চলে যাব। এগারোটার সময় আমার একটা মিটিং আছে। তুই অবিশ্যি দশটার আগে চলে অ্যাসবি।
দেখি।
মিসির আলি লক্ষ করলেন, ইয়াসিন তার ট্রাঙ্ক নিয়ে বের হচ্ছে। ভালো সম্ভাবনা যে সে আর ফিরবে না। নিজের সব সম্পত্তি নিয়ে বের হচ্ছে। এই ট্রাঙ্কটা সম্পর্কে মিসির আলির সামান্য কৌতুহল আছে। ইয়াসিন ট্রাঙ্কে বড় একটা তালা বুলিয়ে রাখে। গভীর রাতে শব্দ শুনে মিসির আলি টের পান যে তালা খোলা হচ্ছে।
তুই কি সকালে সত্যি আসবি?
হ্যাঁ।
ট্রাঙ্ক নিয়ে যাচ্ছিস কেন?
প্রয়োজন আছে।
আচ্ছা যা।
ইয়াসিন পা ছুঁয়ে তাকে সালাম করল। এটা নতুন কিছু না। ইয়াসিন বাইরে যাবার আগে তার পা ছুঁয়ে সালাম করে।
মিসির আলি বিছানা থেকে নামলেন। দরজা বন্ধ করে ঘড়ি দেখতে বসার ঘরে গেলেন। ঘড়ির দুটা কাঁটা তিনের ঘরে এই কথাটা ইয়াসিন মিথ্যা বলে নি। তিনটা পনেরো মিনিটে ঘড়ি বন্ধ হয়ে গেছে। ব্যাটগরি শেষ হয়েছে নিশ্চয়ই। ঘরে একটা মাত্র ঘড়ি। তার নিজের হাতঘড়িটা মাস তিনেক হল হারিয়েছেন। কাজেই রাতে আর সময় জানা যাবে না।
মিসির আলি সূক্ষ্ম অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করলেন। তাঁর মনে হল সময় জানাটা খুবই দরকার। ঘরে খাবার পানি না থাকলে সঙ্গে সঙ্গে পানির পিপাসা পেয়ে যায়। তৃষ্ণায় বুকের ছাতি শুকিয়ে আসে। ঘরে পানি থাকলে কখনো এত তৃষ্ণা পেত না।
সময় জানার জন্য মিসির আলি উসখুসি করতে লাগলেন। যদিও সময় এখন না। জানলেও কিছু না। তাঁর ঘুমিয়ে পড়ার কথা! শরীর ভালো যাচ্ছে না। বুকে প্রায় সময়ই চাপ বোধ করেন। রাতে হঠাৎ হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়। তখন মনে হয় বুকের উপর কেউ যেন বসে আছে। সেও স্থির হয়ে বসে নেই, নড়াচড়া করছে। তিনি উঠে বসেন। বিছানা থেকে নামেন। বুকের উপর বসে থাকা বস্তুটা কিন্তু তখনো থাকে। টিকটিকির মতো বুকে সেঁটে থাকে। এইসব লক্ষণ ভালো না। এসব হচ্ছে ঘণ্টা বাজার লক্ষণ। প্রতিটি জীবিত প্রাণীর জন্য ঘণ্টা বাজানো হয়। জানিয়ে দেওয়া হয় তোমার জন্য অদৃশ্য ট্রেন পাঠানো হল। এ তারই ঘণ্টা। ভালো করে তাকাও দেখবে সিগন্যাল ডাউন হয়েছে। ট্রেন চলে আসার সবুজ বাতি জ্বলে উঠেছে। ট্রেন থামতেই তুমি টুক করে তোমার কমরায় উঠে পড়বে। না তোমাকে কোনো সুটকেস, বেডিং নিতে হবে না। ট্রেনটা যখন তোমাকে নামিয়ে দিয়ে গিয়েছিল তখন যেভাবে এসেছিলে যাবেও সেইভাবে। ট্রেন থামতে থামতে যাবে, নানান যাত্রী উঠবে।—সবার গন্তব্য এক জায়গায়। সে জায়গাটা সম্পর্কে করোরই কোনো ধারণা নেই।
মিসির আলি দরজা খুললেন। বারান্দায় এস বসলেন। বুকে চাপ ব্যথাটা আবারো অনুভব করছেন। ফাঁকা জায়গায় বসে বড় বড় নিশ্বাস ফেললে আরাম হবার কথা। সেই আরামটা হচ্ছে না। মিসির আলির দু কামরার এই বাড়িটার আবার একটা বারান্দাও আছে। গ্রিল দেওয়া বারান্দা। বারান্দাটা এত ছোট যে দুটা চেয়ারেই বারান্দা ভর্তি। মিসির আলি এই বারান্দায় কখনো বসেন না। গ্রিল দেওয়ার কারণে বারান্দাটা তার কাছে জেলখানার গরীদের মতো লাগে। বারান্দা থাকবে খেলামেলা; এবং অতি অবশ্যই বারান্দা থেকে আকাশ দেখা যাবে। জানালা মানে যেমন আকাশ, বারান্দা মানেও আকাশ। গ্রিল দেওয়া এই বারান্দা থেকে আকাশ দেখা যায় না।
বারান্দা থেকে বাড়িওয়ালা বাড়ির খানিক অংশ এবং নর্দমাসহ গলি ছাড়া কিছুই দেখা যায় না। মিসির আলির খুব ইচ্ছা অন্তত জীবনের শেষ কিছুদিন তিনি এমন একটা বাড়িতে থাকবেন যে বাড়ির বড় বড় জানালা থাকবে। জানালার পাশ থেকে আকাশ দেখা যাবে। জীবনের শেষ সময় এসে পড়েছে বলেই তার ধারণা-জানালাওয়ালা বারান্দার কোনো ব্যবস্থা এখনো হয় নি। তবে তীর ধারণা তার শেষ ইচ্ছােটা পূর্ণ হবে। গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় তাঁর আত্মীয়স্বজনরা অবশ্যই তাকে কোনো একটা ভালো ক্লিনিকে ভর্তি করবে। সেই ক্লিনিকের ভাড়া তিনি দিতে পারবেন কি পারবেন না তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না।
ক্লিনিকে তাঁর বিছানাটা থাকবে জানালার কাছে। তিনি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকতে পারবেন। ডাক্তার এবং নার্সরা মিলে তাঁর জীবন রক্ষার জন্যে যখন ছোটাছুটি করতে থাকবেন, তিনি তখন তাকিয়ে থাকবেন আকাশের দিকে। মৃত্যুর আগে আগে শারীরবৃত্তির সকল নিয়মকানুন এলোমেলো হয়ে যায়। কাজেই তিনি হয়তো তখন আকাশের কোনো অদ্ভূত রঙ দেখবেন। নীল আকাশ হঠাৎ দেখা গেল গাঢ় সবুজ হয়ে গেছে। কিংবা আকাশ হয়েছে বেগুনি। বেগুনি তাঁর প্রিয় রঙ।
স্যার স্নামালিকুম।
মিসির আলি চমকে তাকালেন। বাড়িওয়ালা বদরুল সাহেবের ভাগ্নে ফতে মিয়া। আপন ভাগ্নে না। দূরসম্পর্কের ভাগ্নে। ফতে মিয়া মিসির আলির ঠিক সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু তিনি তাকে তাঁর সামনে এসে দাঁড়াতে দেখেন নি। যখন চোখ বন্ধ করে ছিলেন তখন এসেছে। ফতে মিয়ার চলাফেরা সম্পূর্ণ নিঃশব্দ। মানুষটা মনে হয়। বাতাসের ওপর চলে। মানুষটা বাতাসের ওপর দিয়ে চলাফেরা করার মতো ছোটখাটো না। তার শরীর-স্বাস্থ্য ভালো। শুধু শরীরের তুলনায় মাথাটা ছোট। দেখে মনে হয় খুব রোগা কোনো মানুষের মাথা একজন কুস্তিগিরের শরীরে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। ফতে মিয়ার গলার স্বর পরিষ্কার; ঝনঝনি করে কথা বলে।