ফতে নিজেকে সামলে নিয়ে কঠিন গলায় বলল, আমি কী করি তা দিয়ে আপনার প্ৰয়োজন কী?
লোকটা বলল, প্রয়োজন নেই। শুধুই কৌতূহল।
ফতে বলল, এত কৌতূহল ভালো না।
এই বলেই সে আর দাঁড়াল না। হাঁটতে শুরু করল। কিছুদূর যাবার পর পেছন ফিরে দেখে লোকটা তার পেছনে পেছনে আসছে। ফতের বুক আবার ধড়ফড় করতে শুরু করল। সে দৌড়াতে শুরু করল। তখন ঐ লোকটা দাঁড়িয়ে পড়ল, তবে তাকিয়ে রইল। ফতের দিকে। দৃশ্যটা মনে পড়লেই ফতের বুক কাঁপে।
মিসির আলির ব্যাপারটা ফতে ঠিক ধরতে পারছে না। ফতেরা যে ক্ষমতা এই মানুষটার কি সেই ক্ষমতা আছে? মাঝে মাঝে মনে হয় আছে–আবার মাঝে মাঝে মনে হয় নেই। মিসির আলির মাথায় বেশিরভাগ সময়ই ফতে ঢুকতে পারে না। সন্দেহটা সেই কারণেই হয়। যতবার ফতে মিসির আলির মাথার ভিতর ঢুকেছে ততবারই সে ধাক্কার মতো খেয়েছে। লোকটা একসঙ্গে অনেক কিছু চিন্তা করছে। তিনটা-চারটা চিন্তা কোনো মানুষ একসঙ্গে করছে—এমন কারোর সঙ্গেই ফতের এর আগে দেখা হয় নি। ফতে মিসির আলির ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হতে চায়। পুরোপুরি জানতে চায় এই মানুষটারও কি তার মতো ক্ষমতা আছে?
ফতের মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে তার ক্ষমতার ব্যাপারটা মিসির আলিকে খোলাখুলি বলে। কিন্তু তার মন সায় দেয় না। লোকটাকে এটা বলে তার লাভ কী। এমন তো না যে এটা কোনো অসুখ সে অসুখ থেকে মুক্তি চায়। আগবাড়িয়ে বললে–একজন তার গোপন ব্যাপারটা জেনে ফেলবে। একজন জানা মানেই অনেকের জানা। কী দরকার।
মিসির আলির গোসল শেষ হয়েছে। তিনি এসে ফতের সামনের চেয়ারে বসেছেন। ফতে খুবই হতাশা বোধ করছে। মিসির আলির মাথার ভেতর সে ঢুকতে পারছে না। ইয়াসিন এসে পরোটা এবং বাটিতে করে মুরগির লটপট দিয়ে গেল। ফতে বলল, স্যার খান এর নাম মুরগির লটপটি।
মিসির আলি কোনো কথা না বলে খেতে শুরু করলেন। ফতে বলল, খেতে কেমন স্যার?
মিসির আলি বললেন, ভালো।
আপনার কি শরীর খারাপ? –
না শরীর খারাপ না। মেজাজ। সামান্য খারাপ। কোনো কারণ ছাড়াই খারাপ।
আমি বেশিক্ষণ থাকব না। স্যার। নাশতা খেয়ে আপনার ফতুয়ার মাপটা নিয়ে কাপড় কিনতে যাব। কী রঙের কাপড় আপনার পছন্দ?
মিসির আলি বললেন, কাপড়ের রঙ নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। শুধু কটকট না করলেই হল।
হালকা নীল রঙ কিনব স্যার?
কিনতে পার।
কাপড়ের দামটা স্যার আমি দিব। আপনি যদি কিছু মনে না করেন। শুধু দরজির খরচষ্টা। আপনি দিবেন। প্রথম ব্যবসা-বিনা টুটাকায় করা ঠিক না।
মিসির আলি বললেন, আমি দরজির খরচ দেব। কোনো অসুবিধা নেই।
আজ সন্ধ্যার মধ্যে ফতুয়া দোকানে গিয়ে ডেলিভারি নেবেন। কষ্টটা আপনাকে করতে হবে।
আচ্ছা করব। ঠিকানা রেখে যাও, আমি সন্ধ্যার পরপর যাব।
মিসির আলির নাশতা খাওয়া শেষ হয়েছে। তিনি চা খাচ্ছেন। ফতে কয়েকবার চেষ্টা করেও মিসির আলির মাথার ভেতর ঢুকতে পারল না। সে পরিকল্পনা বদলাল। লোকটাকে চমকে দেবার কোনো দরকার নেই। পরে হয়তো দেখা যাবে চমকে দিতে গিয়ে এমন কিছু ঘটল যে উল্টো সে নিজেই চমকাল। লোকটির বিষয়ে আগে সে পুরোপুরি জানবে। তারপর অন্য ব্যবস্থা।
ফতে মাপ নেবার জন্যে ফিতা বের করল। দরজিদের মতোই উঁচু গলায় মাপ বলতে বলতে কাগজে লিখে নিল।
লম্বা – ২৯
বুক – ৩৪
পুট – ৬
হাত – ১২
মুহরি – ১৬
গলা – ১৩.৫
ফতে বলল, একটু দোয়া রাখবেন স্যার দরজির কাজটা যেন তাড়াতাড়ি শিখতে পারি। খবরের কাগজে নকশা করে, খবরের কাগজ কেটে কেটে কয়েকদিন চেষ্টা করেছি আউল লেগে যায়।
মিসির আলি বললেন, সব কাজ সবার জন্যে না।
ফতে সামান্য চমকাল মিসির আলি এই কথাটা কেন বললেন। তিনি কি কিছু বুঝতে পারছেন? না এটা শুধুই কথার কথা। ফতে বলল, স্যার আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব। যদি কিছু মনে না নেন।
জিজ্ঞেস কর।
ফতে মিনমিনে গলায় বলল, আমার বিষয়ে আপনার কী ধারণা?
তোমার প্রশ্নটা বুঝতে পারছি না। আরো পরিষ্কার করে বল।
আমাকে দেখলে আপনার কী মনে হয়?
মনে হয় তুমি সব সময় আতঙ্কে আছে। সবাইকে ভয় পাচ্ছ।
ফতে মুখ শুকনা করে ফেলল। ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে উঠে পড়ল। তার মাথা ঝিমঝিম করছে। এই লোক কী করে বুঝল সে সবাইকে ভয় পায়। তার ভয় তো সে প্রকাশ করে না। নিজের ভিতর লুকিয়ে রাখে। লুকানো জিনিস সে জানল কীভাবে?
স্যার আমি যাই?
ফতুয়ার লেখা কাগজটা ফেলে গেছি। মাপটা নিয়ে যাও। লম্বার মাপে ভুল আছে-লম্বা বাইশ। তুমি মাপ নিয়েছ বাইশের বলেছ ঊনত্রিশ, লিখেছও ঊনত্রিশ।
মিসির আলি সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘরেই থাকলেন। প্রতিমা এল না। এতে তার টেনশন কমল মা-যে কোনো সময় চলে আসবে। এই টেনশন থেকেই গেল।
সন্ধ্যায়, ফতুয়া আনতে গেলেন। দরজির দোকান ফতে সুন্দর সাজিয়েছে। ঝলমলে বাতি জুলছে। টাকা দিয়ে মিসির আলি ফতুয়া নিলেন। দোকানের মালিক ফতে ছিল না। মিসির আলি কেমন যেন স্বস্তিবোধ করলেন। স্বস্তিবোধ করার কারণটা তার কাছে স্পষ্ট না। মিসির আলি মাথা নিচু করে হাঁটছেন। বাসায় ফিরে যেতে ইচ্ছা করছে না। তার মনে ক্ষীণ সন্দেহ-বাসায় ফিরে দেখবেন প্রতিমা এসেছে। দেড়টনি একটা ট্রাক নিয়ে এসেছে। সে ট্রাকে মিসির আলির জিনিসপত্র তুলে অপেক্ষা করছে কখন মিসির আলি আসবেন।
এতটা এই মেয়ে নিশ্চয়ই করবে না, আবার করতেও পারে। অস্বাভাবিক মানুষ পারে না এমন কোজ নেই। কাউকে চট করে অস্বাভাবিক বলা ঠিক না। মানুষ স্বাভাবিক এবং অস্বাভাবিকের সীমারেখায় বাস করে। একজন স্বাভাবিক মানুষ মাঝে মধ্যে অস্বাভাবিক আচরণ করে, আবার খুবই অস্বাভাবিক মানুষ হঠাৎ স্বাভাবিক আচরণ করে। এখানেও কথা আছে-কোন আচরণগুলিকে আমরা স্বাভাবিক আচরণ বলব। স্বাভাবিকের মানদণ্ড কে ঠিক করে দেবো? মিসির আলি যে আচরণকে স্বাভাবিক ভাবছোন-ফতে মিয়া কি তাকে স্বাভাবিক ভাববে?