তুমি দৈনিক কত ঘণ্টা পড়াশোনা কর?
আমি দৈনিক পাঁচ থেকে ছঘণ্টা পড়াশোনা করি।
তুমি অবসর সময়ে কী করা?
আমি অবসর সময়ে গল্পের বই পড়ি। টিভি দেখি।
তোমার পড়াশোনার পেছনে কার অনুপ্রেরণা সবচেয়ে বেশি কাজ করে?
আমার পিতা-মাতা এবং শিক্ষক-শিক্ষিকা।
তুমি কি কোনো কোচিং সেন্টারে যাও?
আমি একটি কোচিং সেন্টারে সপ্তাহে তিনদিন যাই।
তোমার সাফল্যের রহস্য কী?
আমি দিনের পড়া দিনে তৈরি করে রাখি।
তোমার বয়সী ছাত্রছাত্রীদের প্রতি তোমার কী উপদেশ?
তোমরা নিয়মিত পড়াশোনা কর।
ফার্স্ট গার্ল নাজনিন বেগমের ইন্টারভ্যু শেষ করে মিসির আলি ভিকারুননিসা নূন স্কুলের শিক্ষিকার কঠিন উপদেশগুলি পড়তে শুরু করলেন। তার খানিকটা মন খারাপ হতে শুরু করেছে–তার কাছে মনে হচ্ছে সবাই বাচ্চাগুলির পেছনে লেগেছে। শিশুর স্বপ্ন, শিশুর আনন্দ কেড়ে নেবার খেলা শুরু করেছে। শিশুদের শিশুর মতো থাকতে দিলে কেমন হয়। বৃত্তি পরীক্ষা উঠিয়ে দিলে কেমন হয়ঃ পরীক্ষার ব্যাপারটা কি উঠিয়ে দেওয়া যায় না। পরীক্ষা নামের ব্যাপারগুলি রেখে অতি অল্পবয়সেই শিশুদের মাথায় একটা জিনিস আমরা ঢুকিয়ে দিচ্ছি–তোমাদের মধ্যে কেউ ভালো, কেউ খারাপ। তোমাদের মধ্যে একদল বৃত্তি পায়, একদল পায় না। তোমাদের মধ্যে একজন হয়। ফার্স্ট গার্ল নাজনিন। আরেকজন খুব চেষ্টা করেও দশের ভেতর থাকতে পারে না। যেদিন স্কুলে রেজাল্ট দেয় সেদিন সে কান্না কান্না মুখে বাড়ি ফেরে। এবং তার মা মেয়ের ওপর প্রচণ্ড রাগ করেন। এই মা-ই আবার মেয়েকে গান শেখান–আমরা সবাই রাজা, আমাদের এই রাজার রাজত্বে।
আমরা যে সবাই রাজা না, কেউ কেউ রাজা কেউ কেউ প্ৰজা, পরীক্ষা নামক ব্যবস্থাটা তা চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয়।
মিসির আলি পত্রিকা ভাঁজ করে রাখলেন। মশারির ভেতর থেকে বের হলেন না। সকালে মশারির ভেতর থেকে তিনি বেশ আয়োজন করে বের হন। যেন তিনি জেলখানা থেকে মুক্তি পাচ্ছেন, সারা দিন কাজকর্ম করবেন আবার রাত এগারোটা বারোটায় জেলখানায় ঢুকবেন।
কলিংবেল বাজছে।
নটা বাজে। প্রতিমা এসে পড়েছে। সে নটায় আসবে বলেছিল-ঠিক নটায় এসেছে। পাঁচ-ছমিনিট আগেই হয়তো এসেছে। গেটের কাছে দাঁড়িয়ে নটা বাজার অপেক্ষা করেছে। এ ধরনের মানুষ খুব যন্ত্রণাদায়ক হয়। মিসির আলি ছোট্ট নিশ্বাস ফেললেন। মানুষের সঙ্গ তাঁর কাছে খুব আনন্দদায়ক কোনো ব্যাপার না। তিনি একা থেকে থেকে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। অন্যরা ব্যাপারটা বুঝতে পারে না।
মিসির আলির ধারণা যেসব মানুষ দীর্ঘদিন একা থাকে এবং বই পড়ে সময় কাটায় তারা অন্য রকম। মানুষকেও তারা বই মনে করে। যে বই তার পছন্দ সে লাইব্রেরি থেকে সেই বই টেনে নেয়। ঠিক একইভাবে যে মানুষটি তার পছন্দ সেই মানুষকে সে ডেকে নিয়ে আসে। কোনো মানুষ নিজে তাদের কাছে উপস্থিত হবে এটা তাদের পছন্দ না।
মিসির আলি অপ্ৰসন্ন মুখে মশারির ভেতর থেকে বের হলেন। বসার ঘরে উঁকি দিয়ে দেখেন প্ৰতিমা আসে নি। বেতের চেয়ারে ফতে মিয়া বসে আছে।
স্যার কেমন আছেন?
মিসির আলি বললেন, ভালো আছি।
ফতে বলল, চলে যাচ্ছি। তো স্যার, এইজন্যে আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। একটু দোয়া রাখবেন।
কোথায় যাচ্ছে?
গতকাল আপনাকে বললাম না। আমি একটা দরজির দোকান দিচ্ছি। এখন থেকে দোকানেই থাকব।
ও আচ্ছা।
আপনাকে একদিন আমার দোকানে নিয়ে যাব।
মিসির আলি ফতের সামনের চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, ঠিক আছে।
আমার একটা আবদার আছে স্যার। যদি রাখেন খুব খুশি হব।
কী অবদার? আমার দোকানের প্রথম দরজির কাজটা আপনাকে দিয়ে করবে। আপনার জন্যে একটা পাঞ্জাবি বা ফতুয়া দিয়ে দোকানের শুরু। আপনাকে কখনো ফতুয়া পরতে দেখি নাই। আপনি কি ফতুয়া পরেন?
পোশাক নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। পোশাক নিয়ে আমি তেমন ভাবি না।
স্যার আপনি কি নাশতা করেছেন?
আমিও নাশতা করি নাই। ইয়াসিনকে বলেছি আমাদের দুজনের নাশতা দিতে। শুধু পরোটা ভাজতে বলেছি। আমি বিরিয়ানি হাউস থেকে মুরগির লটপট নিয়ে এসেছি। মুরগির লটপট জিনিসটা কখনো খেয়েছেন?
না।
হোটেলে অনেক মুরগি রান্না হয় তো। সেই সব মুরগির গিলা, কলিজা, পাখনা, এইগুলো কী করবে? ফেলে তো দিতে পারে না–হোটেলওয়ালারা এইগুলো দিয়ে একটা ঝোলের মতো বানায়। এটাকে বলে লটপট। পরোটা দিয়ে লটপট খেতে খুবই সুস্বাদু।
ও আচ্ছা।
ফতে মিয়া হাসতে হাসতে বলল, সকালবেলা এসে আপনার সঙ্গে বকবক শুরু করেছি, আপনার খুব বিরক্ত লাগছে তাই না স্যার?
মিসির আলি বললেন, খুব বিরক্তি লাগছে না, তবে কিছুটা যে বিরক্ত হচ্ছি না–তা না। অকারণ কথাবার্তা বলতে আমার ভালো লাগে না।
ফতে বলল, আমি তো চলেই যাচ্ছি স্যার। এরপর আর রোজ রোজ এসে আপনাকে বিরক্ত করব না। যান হাত-মুখ ধুয়ে আসুন, একসঙ্গে নাশতা খাই! আমি স্যার গজফিতা নিয়ে এসেছি–আপনার ফতুয়ার মাপ নিব। আমি মাপ নেওয়া শিখেছি। আপনাকে দিয়ে বিসমিল্লাহ করব।
মিসির আলি অপ্ৰসন্ন মুখে বাথরুমের দিকে রওনা হলেন। ফতে মিয়া ঘণ্টাখানেক সময় নষ্ট করবে। এটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। এর মধ্যে নিশ্চয়ই প্ৰতিমা চলে আসবে। সে তো আর সহজে যাবে না। বাজারটাজার নিয়ে আসবে। মহাউৎসাহে মাছ ভাজতে শুরু করবে। ঘর ধোয়া মোছা করবে। প্রতিমার কর্মকাণ্ড এখানেই শেষ হবে না। সে অবশ্যই চেষ্টা করবে তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যেতে। বাড়াবাড়ি এই মেয়ে করবেই। মানুষের জিনের মধ্যে এমন কিছু কি আছে যা তাকে দিয়ে বাড়াবাড়ি করায়। ডিএনএ অণুতে প্রোটিনের এমন কোনো বিশেষ অবস্থান যা বাড়াবাড়ি করতে বিশেষ বিশেষ মানুষকে প্রেরণা দেয়। সেই মানুষ যখন ঘৃণা করে বাড়াবাড়ি ধরনের ঘৃণা করে। যখন ভালবাসে বাড়াবাড়ি ভালবার্সে। অনেক অসুখের মতো এটাও যে একটা অসুখ তা কি মানুষ জানে? এখন না জানলেও একদিন জানবে। কোনো ওষুধ কোম্পানি ওষুধ বের করে ফেলবে। যেসব মানুষের বাড়াবাড়ি করার রোগ আছে তারা ট্যাবলেট খেয়ে রোগ সারাবে। একসময় হুপিং কফ, পোলিওর মতো বাড়াবাড়ি। রোগেরও টিকা বের হবে। শিশুদের বয়স ছয় মাস হবার আগেই তাদের বাড়াবাড়ি প্রবণতা রোগের টিকা দেওয়া হবে। রাস্তায় রাস্তায় পোস্টার দেখা যাবে আপনার শিশুঁকে কি বাড়াবাড়ি প্রবণতার টিকা দিয়েছেন?