বিয়ে বাতিল হয়েছে শুনে ছেলের বাবা-মা দুজনই খুব আপসেট হয়ে পড়লেন। বাবার সঙ্গে নানান কথাবার্তা বলতে লাগলেন। আমার সঙ্গেও কথা বলার চেষ্টা করলেন। আমি কথা বললাম না। শুধু যে ছেলের বাবা-মা আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন তা না, ছেলেও আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইল। বারবার টেলিফোন–সে শুধু পাঁচ মিনিটের জন্যে কথা বলতে চায়।
সেই পাঁচ মিনিট তাকে দেওয়া হল না। তারপরই একটা দুৰ্ঘটনা ঘটল। ছেলেটা রিকশা করে যাচ্ছিল। পেছন থেকে একটা মাইক্রোবাস এসে ধাক্কা দিয়ে তাকে ফেলে দিল। লোকজন ধরাধরি করে তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেল। হাসপাতালে নেবার পথেই সে মারা গেল।
ছেলেটির সঙ্গে আমার কোনো মানসিক বন্ধন তৈরি হয় নি, কাজেই তার মৃত্যু আমার জন্যে ভয়ঙ্কর রকম আপসেট হবার মতো কোনো ঘটনা না। তারপরেও কয়েকদিন আমার মন খারাপ গেল। বেচারা পাঁচ মিনিট আমার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিল। কী হত পাঁচ মিনিট কথা বললে?
আমার সমস্যাটা শুরু হল ছেলেটার মৃত্যুর ঠিক ছদিন পর। আমি আমার ঘরে ঘুমাচ্ছি। টেলিফোনের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। আমার হাতের কাছে টেলিফোন। টেলিফোন ধরার আগে ঘড়ি দেখলাম। রাত তিনটা বাজে। রাত তিনটায় কে টেলিফোন করবে? কোনো ক্র্যাংক কল নিশ্চয় এসেছে। টেলিফোন ধরলেই জড়ানো গলায় কেউ নোংরা কোনো কথা বলবে। ধরব না ধরব না করেও টেলিফোন ধরলাম। হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে লাইন কেটে দিল। আমি বিরক্ত হয়ে টেলিফোন রেখে বাথরুমে গেলাম। রাতে ঘুম ভেঙে গেলে আমার খুব সমস্যা হয়। ঘুম আসতে চায় না। হাত-মুখ ধুয়ে ঘরে ঢুকে অবাক হয়ে দেখি–আমার বিছানায় পা তুলে ছেলেটা বসে আছে। যে বইটা পড়তে পড়তে রাতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সেই বইটা তার হাতে। খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে সে বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছে। আমি ঘরে ঢুকতেই সে বই রেখে বলল, পাঁচটা মিনিট তোমার সঙ্গে কথা বলব। এর বেশি না।
আমি চিৎকার করে মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম। শুরু হল আমার দুঃস্বপ্নের দিনরাত্রি।
এইটুকু পড়েই মিসির আলি খাতা নামিয়ে রাখলেন। মেয়েটির চিকিৎসা কীভাবে করা হয়েছে তাঁর মনে পড়েছে। লেখা পড়ে নুতন কিছু জানা যাবে না। মিসির আলির ঘুম পাচ্ছে। বরং কিছুক্ষণ ঘুমানো যেতে পারে। ঘুমের মধ্যে বৃষ্টি নামলে চমৎকার হয়। বৃষ্টির শব্দটা কোনো-না-কোনো ভাবে ঘুমন্ত মানুষের মাথায় ঢুকে যায়। ঝমোঝম শব্দে আনন্দময় বাজনা মাথার ভেতর বাজতে থাকে। মানুষের অবচেতন মন বৃষ্টির গান খুবই পছন্দ করে। কেন করে তার নিশ্চয়ই কারণ আছে। কারণটা একদিন ভেবে দেখতে হবে।
দিন শুরু হয়েছে রুটিন মতোই
মিসির আলির দিন শুরু হয়েছে রুটিন মতোই। সকালে ঘুম ভাঙতেই দেখেছেনমশারির ভেতর দিয়ে খবরের কাগজটা ঢুকিয়ে দেওয়া। একসময় বাসিমুখে খবরের কাগজ পড়তে তিনি আনন্দ পেতেন, এখন পান না, কিন্তু অভ্যাসটা রয়ে গেছে। অভ্যাস সহজে যায় না। খবরের কাগজ পড়তে পড়তেই ইয়াসিন চা নিয়ে আসে। মশারির ভেতরে ঢুকিয়ে গলা খাকারি দেয়। সেই চা, চা-না অতিরিক্ত চিনির কারণে সিরাপ জাতীয় ঘন তরল পদার্থ। ইয়াসিনকে অনেক বলেও চিনি কমানোর ব্যবস্থা মিসির আলি করতে পারেন নি। এখন মিসির আলির গরম সিরাপ খাওয়া অভ্যাস হয়ে গেছে। প্রায়ই তাকে বলতে শোনা যায়-ইয়াসিন আরেক চামচ চিনি দে। ইংরেজি প্রবচনটা এতই সঠিক-Old habit die hard. পুরোনো অভ্যাস সহজে মরে না।
মিসির আলির হাতে খবরের কাগজ। তিনি খবরের কাগজে চোখ বুলাচ্ছেন—হঠাৎ এমন কোনো খবর চোখে পড়ে কি না যা মনে গেঁথে যায়। এমন কিছু চোখে পড়ছে না। হত্যা, ধর্ষণ ছাড়া তেমন কিছু নেই। মিসির আলির মনে হল সব পত্রিকার উচিত এই দুটি বিষয়ে আলাদা পাতা করা। খেলার পাতা, সাহিত্য পাতার মতো ধর্ষণ পাতা, হত্যা পাতা। যারা ঐ সব বিষয় পড়তে ভালবাসে তারা ঐ পাতাগুলি পড়বে। যারা পড়তে চায় না তারা পাতা আলাদা করে রাখবে। বিশেষ দিনে হত্যা এবং ধর্ষণ বিষয়ে সচিত্র ক্রোড়পত্র বের হবে।
পত্রিকায় নতুন একটি বিষয় চালু হয়েছে–জন্মদিনের শুভেচ্ছা। মামণির এক বছর বয়সপূর্তি উপলক্ষে পিতা-মাতার শুভেচ্ছা। মিসির আলি বেশ আগ্রহ নিয়েই পড়ছেন।
অনিক
পৃথিবীতে আজ যত গোলাপ ফুটেছে সবই তোমার জন্যে
তোমার বাঘা ও মা
অনিকের ছবি। দুই হাতে ভর দিয়ে পৃথিবীর সমস্ত গোলাপের মালিক হাঁ করে বসে আছে। তার জিব দেখা যাচ্ছে।
শিপ্রা,
আজ আমাদের শিপ্রার শুভ জন্মদিন
পৃথিবীর সব দুঃখ করবে। সে বিলীন।
শিপ্রার
নানা নানু ছোট মামা, ছোট মামি ও রনি।
পৃথিবীর সমস্ত দুঃখ যে বিলীন করবে। সেই শিপ্রার ক্ৰন্দনরতা একটা ছবি। শিপ্রার হাতে চকবার।
মিসির আলি ছবিটির দিকে তাকিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেলেন। মেয়েটি কাঁদছে কেন? চোখে মুখে কি চকবারের কাঠির খোচা লেগেছে?
জন্মদিনের শুভেচ্ছায় শুধু ছোট মামা, ছোট মামি আছেন। যেহেতু ছোট মামার উল্লেখ করা আছে। অবশ্যই ধরে নিতে হবে বড় মামাও আছেন। বড় মামা-মামি কি আলাদা বাণী দেবেন? তিনি কি পরিবারের সঙ্গে থাকেন না? নাকি বড় মামা মারা গেছেন। শুভেচ্ছা বাণীতে বড় মামা নেই কেন? আরেকটা নাম আছে। রনি! এই রনিটা কে? কাজিন? মামাতো ভাই। শিপ্রা মেয়েটির কি কোনো খালা নেই।
ইয়াসিন চায়ের কাপ মশারির ভেতর ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে। যথারীতি গরম সিরাপ। মিসির আলি চুমুক দিলেন–তার কাছে মনে হল মিষ্টি সামান্য বেশি। তবে খেতে খারাপ না। চায়ে চুমুক দিতে দিতে মিসির আলি শিক্ষার্থীর পাতা উল্টালেন। শিক্ষার্থীর পাতা বলে আরেকটা জিনিস খবরের কাগজে চালু হয়েছে। আজ আছে ক্লাস সিক্সের বৃত্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি বিষয়ে আলোচনা। অগ্রণী গার্লস হাই স্কুলের ফার্স্ট গার্লের ইন্টারভু। ভিকারুননিসা নুন স্কুলের একজন শিক্ষিকার বৃত্তি পরীক্ষার ওপর কিছু-টিপস। মিসির আলি প্রথম পড়তে শুরু করলেন ফার্স্ট গার্ল নাজনিন বেগমের ইন্টারভ্যু–