আমার নাম প্রতিমা। এটা কিন্তু কাগজপত্রের নাম না। কাগজপত্রে আমার নাম আফরোজা। যেহেতু আমার মা খুব শখ করে প্রতিমা নাম রেখেছিলেন, এবং আমার বয়স এক বছর পার হবার আগেই মারা গেছেন সে কারণে মার প্রতি মমতাবশত সবাই আমাকে ডাকা শুরু করল প্রতিমা। মুখে মুখে ডাকনাম এক ব্যাপার, কাগজপত্রে নাম থাকা অন্য ব্যাপার।
আকিকা করে আমার মুসলমানি নাম রাখা হল। তবে সেই নামে কেউ ডাকত না। শুধু বাবা মাঝে মধ্যে ডাকতেন। তখন আমি জবাব দিতাম না।
আমার বাবা আমাকে অতি আদরে মানুষ করতে লাগলেন। তিনি আদর্শ পত্নীপ্রেমিকদের মতো দ্বিতীয় বিয়ে করেন নি। বাড়িতে মাতৃস্থানীয় কেউ না থাকলে তার কন্যার অযত্ন হবে ভেবে তিনি সাৰ্ব্বক্ষণিক একজন নার্স রাখলেন। ছোটবেলায় এই নার্সকেই আমি মা ডাকতাম। আমার বয়স যখন পাঁচ বছর তখন কী একটা কারণে যেন এই নার্স মহিলাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। শৈশবের এই স্মৃতিটি আমার মনে আছে। এই মহিলা হাউমাউ করে কাঁদছেন এবং বাবার পা জড়িয়ে ধরতে যাচ্ছেন। বাবা বলছেন-ডোন্ট টাচ মি। ডোন্ট টাচ মি। তোমাকে যে আমি কানে ধরে উঠবাস করাচ্ছি না এই কারণেই তোমার সারা জীবন কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।
যে মহিলাকে আমি মা বলে জানতাম সেই মহিলার এমন হেনস্তা দেখে আমি খুবই অবাক হলে গেলাম। ভয়ে আমার হাত-পা কাঁপতে লাগল। আমাকে অন্য ঘরে নিয়ে যাওয়া হল। আমি এর পরে আর কোনোদিন দেখি নি। বাড়িতে এই মহিলার কোনো ছবি ছিল না বলে কিছুদিনের মধ্যেই আমি তার চেহারাও ভুলে গেলাম। শুধু মনে থাকিল-শ্যামলা একটি মেয়ে-যার মুখ গোলাকার এবং তিনি ঠোঁট গোল করে শিস দিতে খুব পছন্দ করতেন।
শৈশবের ভয়াবহ স্মৃতি এই একটাই। এই স্মৃতির ব্যাপারটা আমাকে সাইকিয়াট্রিস্টদের কাছে বারবার বলতে হয়েছে। বাবা আমাকে নিয়ে অনেক বড় বড় সাইকিয়াট্রিস্টর কাছে নিয়ে গিয়েছেন। তাদের প্রথম প্রশ্নই হল–শৈশবে কোনো দুঃখময় স্মৃতি আছে Painful memory?
মিসির আলি সাহেবও এই প্রশ্ন করলেন। তবে অন্য সাইকিয়াট্রিস্টরা যেমন এই ঘটনা শুনে ঝাঁকের পর ঝাঁক প্রশ্ন করেছিলেন মিসির আলি তা করলেন না। তিনি শুধু বললেন–ঐ মহিলার গলার স্বর কেমন ছিল?
আমি অবাক হয়ে বলেছিলাম। গলার স্বর দিয়ে কী হবে? উনার গলার স্বর কেমন জানতে চাচ্ছেন কেন?
মিসির আলি বললেন, এমনি জানতে চাচ্ছি।
আমি বললাম, গলার স্বর মিষ্টি ছিল। খুব মিষ্টি। উনার বিষয়ে আমার আর কিছু মনে নেই শুধু মনে আছে উনি ঠোঁট গোল করে শিস দিতেন।
মিসির আলি বললেন, আরেকটি জিনিস নিশ্চয়ই তোমার মনে আছে। উনি যে তোমাকে বিশেষ নামে ডাকতেন সেটা তো মনে থাকার কথা।
উনি আমাকে বিশেষ নামে ডাকতেন এটা আপনাকে কে বলেছেন?
কেউ বলে নি। আমি অনুমান করছি।
এ রকম অনুমান কেন করছেন? কেন?
তোমার কথা থেকে মনে হচ্ছে এই মহিলা তোমায় খুবই আদর করত। মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা হচ্ছে অতি আদরের কাউকে বিশেষ নামে ডাকা। যে নামে অন্য কেউ ডাকবে না। এই থেকেই অনুমান করছি তোমাকে বিশেষ কোনো নামে ডাকতেন। সেই বিশেষ নামটা কী?
উনি আমাকে ডাকতেন মাফু। মা বলার পর ফুঁ বলে লম্বা টান দিতেন—এ রকম করে মাফুউউউ।
মিসির আলি হাসলেন এবং প্রায় সেই মহিলার মতো করে ডাকলেন মাফুউউউ। আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম, জি। তিনি বললেন, মাফু তুমি কেমন আছ?
আমি বললাম ভালো নেই। আপনি আমাকে সারিয়ে দিন।
তিনি আবারো হাসলেন। এবং আমার সঙ্গে সঙ্গে মনে হল–ইনি আমাকে সারিয়ে দেবেন। উনার সেই ক্ষমতা আছে।
এখন আমি আমার অসুখের ঘটনাটা বলি-আমি যখন ইউনিভার্সিটিতে থার্ড ইয়ারে পড়ি তখন বাবার শরীর হঠাৎ খারাপ হয়ে গেল। হার্টের সমস্যা, ডায়াবেটিস, অ্যাজমার অ্যাটাক সব একসঙ্গে। তিনি প্রায় শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন। আমাকে একদিন ডেকে নিয়ে বললেন–মা, তোর কি পছন্দের কোনো ছেলে আছে?
আমি বললাম কেন?
বাবা বললেন, তোর কোনো পছন্দের ছেলে থাকলে বল। আমি তোর বিয়ে দিতে চাই। আমার শরীর ভালো না। যে কোনো সময় যে কোনো কিছু ঘটতে পারে। তার আগেই আমি দেখে যেতে চাই তোর সংসার হয়েছে। যার ওপর ভরসা করতে পারিস এমন একজন কেউ তোর আশপাশে আছে।
আমি বললাম, আমার পছন্দের কেউ নেই।
বাবা বললেন, আমি দেখেশুনে তোর জন্যে একজন ছেলে নিয়ে আসি? বাবার হতাশ মুখ দেখে আমার খুবই মায়া লাগল। তখন তার অ্যাজমার টান উঠেছে। বুকের ভেতর থেকে শাঁ শাঁ শব্দ আসছে। মনে হচ্ছে তার ফুসফুসে ছোট কোনো বাঁশি কেউ রেখে দিয়েছে–যেই তিনি লম্বা করে নিশ্বাস নিচ্ছেন। ওমনি সেই বাঁশিতে শব্দ উঠছে। তখন আমার বিয়ে করার কোনো রকম ইচ্ছা ছিল না। বাবার অবস্থা দেখে বললাম, তুমি যা ভালো মনে কর—করতে পার!
বাবা অতি দ্রুত একটা ছেলে যোগাড় করে ফেললেন। ছেলের বাবা মফস্বলের কোনো এক কলেজের অধ্যাপক। বাবা-মার একমাত্র ছেলে। মেডিকেল কলেজে ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। সুন্দর চেহারা। ছেলের সঙ্গে বাবা আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমি দেখলাম ছেলে খুব লাজুক। কথা বলার সময় সে সরাসরি আমার দিকে তাকায় না। অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। আমি তাকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে খেতে গেলাম। সেখানে কথা যা বলার আমিই বললাম। সে শুধু হ্যাঁ হুঁ করল। বিয়ে উপলক্ষে ছেলের বাবা-মা ঢাকায় চলে এলেন। ঢাকায় তারা দুমাসের জন্যে একটা বাড়ি ভাড়া করলেন। সব যখন ঠিকঠাক তখন বাবা বললেন–এখন বিয়ে হবে না। ছেলেটার কিছু সমস্যা আছে। কী সমস্যা বাবা তা ব্যাখ্যা করলেন না।