এই তো আপনার সবকিছু মনে পড়েছে। আপনার জন্যে আমি নেপাল থেকে একটা চাদর এনেছিলাম। চাদরটা আপনি ব্যবহার করছেন দেখে ভালো লাগছে। স্যার এখন বলুন আমি কবে থেকে কাজ শুরু করব?
মিসির আলি থমকে গেলেন। তিনি যে যন্ত্রণার কথা ভুলে গিয়েছিলেন, সেই যন্ত্রণা আবার শুরু হয়েছে।
প্রতিমা বলল, আপনি পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন–ভেবেছিলেন আপনার ঠিকানাটা আমি খুঁজে বের করতে পারব না। দেখলেন, কীভাবে খুঁজে বের করেছি?
দেখলাম।
প্রতিমা বসতে বসতে বলল, স্যার আপনি আমাকে ভয় পান কেন? আমাকে ভয় পাবার কিছু নেই। আমি আপনাকে নিয়ে একটা বই লিখব। আপনার জীবনের বিচিত্র সব ঘটনার নোট নেব। ব্যস ফুরিয়ে গেল।
মিসির আলি কিছু বললেন না। চুপ করে রইলেন–প্রতিমা নামের এই মেয়েটি ভয়াবহ একটা সমস্যা নিয়ে তাঁর কাছে এসেছিল। তিনি সেই সমস্যার দ্রুত সমাধান করেছিলেন। তারপরই মেয়েটির মাথায় ঢুকে গেছে মিসির আলি তাঁর জীবনে যত সমস্যার সমাধান করেছেন সেগুলি সে লিখে ফেলবে।
প্রতিমা হাসতে হাসতে বলল, স্যার আপনি এমন হতাশ চোখে তাকাচ্ছেন কেন? আমি বাঘ-ভাল্লুক কিছু না। আমি খুবই সাধারণ একটা মেয়ে। সাধারণ হলেও ভালো মেয়ে। আমি নানানভাবে আপনাকে সাহায্য করব। মনে করুন সকালবেলা আপনার কাছে এলাম। আপনি কিছুক্ষণ কথা বললেন, আমি নোট নিলাম। তারপর আপনার ঘরের কাজকর্ম গুছিয়ে দিলাম। আমি রান্না করা শিখেছি। আপনার জন্যে রান্ন করলাম।
তোমার এখনো বিয়ে হয় নি?
না। আমি তো আগেই বলেছি–আমি কখনো বিয়ে করব না।
প্রতিমা খিলখিল করে হাসছে। মিসির আলি বললেন, হাসছ কেন?
প্রতিমা বলল, আপনি হতাশ চোখে তাকাচ্ছেন। আপনাকে দেখে খুবই মায়া লাগছে। এই জন্যে হাসছি।
চা খাবে?
না। চা খাব না। আমি চলে যাব। আপনি প্রথম ধাক্কাটা সামলে নিন। তারপর আমি আসব। স্যার, ভালো কথা আপনার সঙ্গে আমার সাক্ষাতের বিবরণ আমি গুছিয়ে লিখে ফেলেছি। কপি আপনার জন্যে নিয়ে এসেছি। কপি আপনি পড়বেন-এবং বলবেন কিছু বাদ পড়েছে কি না। স্যার ঠিক আছে?
হ্যাঁ ঠিক আছে।
আজই পড়বেন। স্যার, আপনি ঘুম থেকে কখন ওঠেন?
রাত করে ঘুমাতে যাই তো, ঘুম ভাঙতে নটা-দশটা বেজে যায়।
আমি যখন চার্জ নেব, আপনাকে ঠিক রাত দশটায় ঘুমাতে যেতে হবে। ভোর ছটায় ঘুম থেকে তুলে দেব। এক ঘণ্টা আপনাকে হাঁটতে হবে। এক ঘণ্টা পর মর্নিং ওয়াক সেরে এসে দেখবেন–ব্রেকফাস্ট রেডি।
মিসির আলি চিন্তিত গলায় বললেন, তুমি এখানে থাকবে নাকি?
প্রতিমা বলল, হ্যাঁ। তবে এ বাড়িতে না। বারিধারায় আমার পাশাপাশি দুটা ফ্ল্যাট আছে–একটায় আপনি থাকবেন, অন্যটায় আমি থাকব। আমি একজন ইনটেরিয়ার ডিজাইনারকে খবর দিয়েছি–সে আপনার ফ্ল্যাটটা আপনার প্রয়োজনমতো সাজিয়ে দেবে। লাইব্রেরি থাকবে, লেখার টেবিল থাকবে।
আমাকে গিয়ে তোমার ফ্ল্যাটে উঠতে হবে?
হ্যাঁ। স্যার এ রকম শুকনা মুখ করে তাকালে হবে না। আমি আগামীকাল সকাল নটার সময় আসব। ঝড়-বৃষ্টি-সাইক্লেন-হরতাল যাই হোক না কেন সকাল নটায় আমি উপস্থিত হব।
ঠিক আছে।
এর মধ্যে আমার লেখাটা পড়ে ফেলবেন। লেখার কিছু কিছু অংশ ভালোমতো দেখে দেবেন। আমি দাগ দিয়ে রেখেছি।
তুমি কি এখন চলে যাচ্ছ?
প্রতিমা হাসতে হাসতে বলল, হ্যাঁ–তবে কাল দেখা হবে। ঠিক সকাল নটায়। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। লাভ নেই–আপনি নিশ্চয়ই একদিনের মধ্যে বাড়ি বদলাতে পারবেন না?
মিসির আলির মনে হল মেয়েটা পুরোপুরি সুস্থ না। কিছু সমস্যা তার এখনো রয়ে গেছে।
.
মিসির আলি দুপুরের খাওয়া শেষ করে ঘড়ির দিকে তাকালেন, দুটা পঁচিশ বাজে। বিছানায় এসে কিছুক্ষণ গড়াগড়ি করা যায়। দুপুরের খাবার শেষ করে বই হাতে বিছানায় কত হবার মধ্যে আনন্দ আছে। শরীর ভরা আলস্য, চেখভর্তি ঘুম-হাতে চমৎকার একটা বই। আজ অবিশ্যি হাতে বই নেই–প্রতিমা নামের জ্বলন্ত মোমবাতির লেখা বাহান্ন পৃষ্ঠার খাতা। হাতের লেখা না, কম্পিউটারে কম্পোজ করা হয়েছে, স্পাইরেল বাইন্ডিং করা হয়েছে। হাতের লেখা হলে ভালো হত। মানুষ তার চরিত্রের অনেকখানি হাতের লেখায় প্রকাশ করে। কারো লেখা হয় জড়ানো। একটা অক্ষরের গায়ে আরেকটা অক্ষর মিশে থাকে। কেউ কেউ লেখে গোটা গোটা হরফে। কেউ প্রতিটি অক্ষর ভেবেচিন্তে লেখে। কেউ অতি দ্রুত লেখে। লেখা দেখেই মনে হয় তার চিন্তা করার ক্ষমতা দ্রুত। সে মাথার চিন্তাকে অনুসরণ করছে বলে লেখাও দ্রুত লিখতে হচ্ছে। তবে কেউ কেউ লেখে টিমোতালে।
কম্পিউটার মানুষকে অনেক কিছু দিচ্ছে, আবার অনেক কিছু কেড়েও নিচ্ছে। কম্পিউটারের লেখায় কোনো কাটাকুটি নেই। হাতের লেখায় কাটাকুটি থাকবেই। সেই কাটাকুটিই হবে মানুষের চরিত্রের রহস্যের প্রতিফলন। হাতের লেখার যুগ পার হয়েছে। এখন শুরু হয়েছে কম্পিউটারে লেখার যুগ। এই যুগ শেষ হয়ে নতুন যুগ আসবে। কী রকম হবে সেটা? মানুষ চিন্তা করছে আর সেই চিন্তা লেখা হয়ে বের হয়ে আসবে? সে রকম কিছু হলে মন্দ হয় না। তা হলে সেই যুগ হবে হাতের লেখার যুগের কাছাকাছি। কারণ চিন্তার মধ্যেও কাটাকুটি থাকবে।
প্রতিমার লেখার ওপর মিসির আলি চোখ বুলাতে শুরু করলেন। তাঁর কাছে মনে হচ্ছে তিনি কোনো গল্পের বই পড়ছেন। মেয়েটা সে রকম ভঙ্গিতেই লেখার চেষ্টা করছে। লেখার ভঙ্গিটা জার্নালিস্টিক হলে ভালো হত। প্রতিমা লিখছে–