গত সপ্তাহে এই টেবিল থেকেই পাঁচ শ টাকার একটা নোট হারিয়েছে। সেই নোটও কলম দিয়ে চাপা দেওয়া ছিল। তিনি যখন ইয়াসিনকে জিজ্ঞেস করলেন, একটা পাঁচ শ টাকার নোট রেখেছিলাম নোটটা কোথায় রে?
ইয়াসিন বলল, জানি না।
তুই নিয়েছিস নাকি?
না।
ভালো করে মনে করে দেখ নোটটা নিয়ে মনের ভুলে পকেটে রেখেছিস কি না।
ইয়াসিন আবারো বলল, না। তারপর থমথমে মুখে রান্নাঘরে ঢুকে গেল। মিসির আলির সামান্য মন খারাপ হল–ছেলেটা কি চুরি করা শিখছে? এবং এই চুরি শেখার জন্যে নানান জায়গায় টাকা পয়সা ছড়িয়ে রেখে তাকে সাহায্য করছে? তিনি এই বিষয়ে ইয়াসিনকে আর কিছু বলেন নি। ভেবে রেখেছিলেন, সময় সুযোগমতো নানান ব্যাখ্যা দিয়ে চুরি যে গুরুতর অপরাধের একটি তা বুঝিয়ে দেবেন। সেই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে আর যাওয়া হয় নি। তারপর ঘটনাটা ভুলেই গেছেন। আজ টেবিলে পঁচিশ টাকার নোট পড়ে থাকতে দেখে মনে পড়ল। তিনি ইয়াসিনকে ডাকলেন। শান্ত গলায় বললেন, টেবিলের ওপর পাঁচ শ টাকার নোট কে রেখেছে, তুই?
ইয়াসিন হ্যাঁ-না, কিছুই বলল না।
মিসির আলি বললেন, যে নোটটা হারিয়েছিল, এটা কিন্তু সেই নোট না। হারানো নোটটা ছিল ময়লা। আর এই নোটটা চকচক করছে।
ইয়াসিন তার পরেও মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।
তুই এখন করছিস কী?
রান্ধি।
কী, রাঁধিস?
হুকনা মরিচের ভর্তি, ডাইল আর ডিমের সালুন।
রান্না শেষ করার পর আমার কাছে আসবি-পাঁচ শ টাকার নোটের বিষয়ে কথা বলব। আমাকে ভয় পাবার কিছু নেই। আমি কখনো কাউকে শাস্তি দেই না। তুই কি আমাকে ভয় পাস?
না।
ইয়াসিন রান্নাঘরের দিকে চলে যাচ্ছে। আসন্ন বিচারসভা নিয়ে তাকে তেমন চিন্তিত মনে হচ্ছে না। তার পেট থেকে কোনো কথা বের করা যাবে এটাও মিসির আলির মনে হচ্ছে না। মানুষ দু শ্রেণীর–এক শ্রেণীর মানুষ কিছুতেই ভাঙবে না। তবে মাচকাবে। আরেক শ্রেণীর মানুষের চরিত্রে মাচকানোর ব্যাপারটি নেই। সে ভেঙে দুটুকরা হবে, কিন্তু কিছুতেই মাচকাবে না। ইয়াসিন দ্বিতীয় শ্রেণীর। পঁচিশ টাকার নতুন নোট প্রসঙ্গে তার মুখ থেকে একটি বাক্যও বের করা যাবে না। সে পাথরের মতো মুখ করে মেজের দিকে তাকিয়ে থাকবে। বিড়াল যেমন গড়গড় শব্দ করে, মাঝে মাঝে এই ধরনের শব্দ করবে।
বিজ্ঞান দ্রুত এগুচ্ছে—এমন যন্ত্র হয়তো খুব শিগগিরই বের হয়ে যাবে যার সামনে কাউকে বসালে তার মাথায় কী আছে সব পরদায় পরিষ্কার দেখা যাবে। মস্তিষ্কে জমা স্মৃতি ভিডিওর মতো পরদায় চলে আসবে। কোনো অপরাধী বলতে পারবে না–এই অপরাধ সে করে নি। মস্তিষ্ক থেকে স্মৃতি বের করে পরদায় নিয়ে আসা খুব কঠিন কোনো প্রযুক্তি বলে মিসির আলির মনে হয় না। আগামী বিশ-পঁচিশ বছরেই গুরুত্বপূর্ণ এই ব্যাপারটা ঘটে যাবে।
.
কিছুদিন আগে মিসির আলি কাগজে পড়েছেন—দুই ভাড়াটে খুনির ফাঁসি হয়ে গেছে। যারা তাকে ভাড়া করেছে তাদের কিছু হয় নি। তারা বেকসুর খালাস পেয়েছে। কারণ প্রমাণ নেই। নতুন পৃথিবীতে প্রমাণের জন্যে মাথা ঘামাতে হবে না। আদালতের নির্দেশে মাথা থেকে স্মৃতির টেপ সরাসরি নিয়ে নেওয়া হবে। নতুন পৃথিবীতে নির্দোষ মানুষ কখনো শাস্তি পাবে না।
মিসির আলি বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকালেন। মেঘ আরো ঘন হয়েছে। শীতের ধূলি ধূসরিত শুকনো শহর তৃষিতের মতো তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। এখন যদি কোনো কারণে বৃষ্টি না হয় তা হলে কষ্টের ব্যাপার হবে।
স্যার গো।
মিসির আলি চমকে তাকালেন। দরজা ধরে ইয়াসিন দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখে দুশ্চিন্তার লেশমাত্র নেই। বরং মুখ হাসি হাসি।
কী ব্যাপার ইয়াসিন?
একটা মেয়েছেলে আসছে। আপনেরে চায়।
মিসির আলি বসার ঘরে চলে এলেন। খুবই আধুনিক সাজ পোশাকের একজন তরুণী! গায়ে বোরকা জাতীয় কালো পোশাক যা ঠিক বোরকাও না। মাথায় স্কার্ফ বাঁধা। স্কার্কের উজ্জ্বল রঙ। সাধারণত মরুভূমির মেয়েরা এমন উজ্জ্বল রঙ ব্যবহার করে। মেয়েটি রূপবতী। তাকে দেখেই মিসির আলির মনে যে উপমা এল তা হল জ্বলন্ত মোমবাতি। মিসির আলি মেয়েটিকে চিনতে পারলেন না। মেয়েটি মিসির আলিকে দেখেই চট করে উঠে দাঁড়াল। এবং তিনি কিছু বুঝতে পারার আগেই তাকে এসে সালাম করে ফেলল।
স্যার আমাকে চিনতে পারছেন?
না।
ভালো করে আমার দিকে তাকান। ভালো করে না তাকালে আপনি আমাকে চিনবেন কী করে। আপনি তো কখনো কোনো মেয়ের দিকে ভালো করে তাকান না।
মিসির আলি ভালো করে তাকালেন। লাভ হল না। তিনি তখনো চিনতে পারছেন না।
মেয়েটি বলল, আমার নাম প্রতিমা। হিন্দু নাম। কিন্তু আমি মুসলমান মেয়ে এখন চিনতে পেরেছেন?
না।
মাথায় স্কার্ফ আছে বলে আপনি হয়তো চিনতে পারছেন না। আপনার সঙ্গে যতবার দেখা হয়েছে কখনোই মাথায় স্কার্ফ ছিল না। মাথাভর্তি চুল ছিল। এখন স্কার্ফ থাকায় হয়তো অচেনা লাগছে।
মেয়েটি মাথার স্কার্ক খুলে মাথায় ঝাঁকুনি দিল। সঙ্গে সঙ্গে মাথার চুল চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। মিসির আলি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলেন। এমন রূপবতী একজনকে দেখতে পাওয়াও ভাগ্যের ব্যাপার।
স্যার আমাকে এখন কি চিনতে পেরেছেন?
হ্যাঁ।
কেন আমার নাম প্রতিমা, এটা মনে পড়েছে?
হ্যাঁ মনে পড়েছে। তোমার মা এক দুপার বেলায় গান শুনছিলেন। প্রতিমা নামের একজন গায়িকার গান–একটা গান লিখ আমার জন্য। এই গান শুনতে শুনতে তোমার মা আবেগে দ্রবীভূত হলেন। তাঁর চোখে পানি এসে গেল। তার কিছুক্ষণ পর তোমার মার ব্যথা শুরু হল। তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। আট ঘণ্টা পর তোমার জন্ম হল। এই আট ঘণ্টা তীব্র ব্যথার মধ্যে তোমার মায়ের মাথায় একটা গান লিখা আমার জন্য ঘুরতে লাগল। যখন তিনি শুনলেন, তাঁর মেয়ে হয়েছে–গায়িকার নামে মেয়ের নাম রাখলেন, প্রতিমা।