এ ধরনের সেমিনারে মিসির আলি প্ৰথমে এক কাপ কফি নিয়ে নেন। শুরুতে চা এবং কফির টেবিল খালি থাকে। কোনোরকম ধাক্কাধাব্ধি ছাড়াই চা-কফি নিয়ে নেওয়া যায়। নাশতার টেবিলের ভিড় যখন কমে তখন সেখানে নাশতা থাকে না।
আজ ঘটনা অন্য রকম হল। মিসির আলি কফি নিয়ে এক কোনায় বসে কফিতে চুমুক দিচ্ছেন! তাঁর সিগারেট খেতে ইচ্ছা করছে কিন্তু জায়গাটা স্মোক ফ্রি কি না বুঝতে পারছেন না। অ্যাশট্রে চোখে পড়ছে না। এই সময় মিসির আলির পেছনে প্রফেসর স্ট্রাইনার এসে উপস্থিত হলেন। বিশুদ্ধ বিস্ময় নিয়ে সাউথের উচ্চারণে ইংরেজিতে বললেন–প্রফেসর মিসির আলি না? আমার কথা মনে আছে?
মিসির আলি বললেন, হ্যাঁ মনে আছে।
আপনি বাংলাদেশের তা ধারণা ছিল না। আমি জানতাম আপনি শ্ৰীলংকান।
মিসির আলি বললেন, আপনি তেমনভাবে আমার খোঁজ নেবার চেষ্টা করেন নি। ভাসা ভাসা খোঁজ নিয়েছেন কাজেই ভাসা ভাসা তথ্য পেয়েছেন।
প্রফেসর স্টাইনার খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েন তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে মিসির আলির পরিচয় করিয়ে দেবার জন্যে। তিনি মিসির আলির হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন তাঁর স্ত্রীর কাছে! মুগ্ধ গলায় বললেন–কেরোলিন ইনি হচ্ছেন প্যারাসাইকোলজির গুরু। উনার কিছু প্ৰবন্ধ নিয়ে কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি একটি বই প্রকাশ করেছে। বইটির নাম দি থার্ড কামিং। আমি বইটি তোমাকেও পড়তে দিয়েছিলাম। আমি নিশ্চিত তুমি পড় নি। না পড়লেও পৃথিবী নামক এই গ্রহের কয়েকটি শুদ্ধতম ব্রেইনের অধিকারীদের একজনের সঙ্গে হ্যান্ডশেক কর। এই ঘটনার পর মিসির আলির আর নাশতার জন্যে চিন্তা করতে হল না। বিশিষ্ট মেহমানদের সঙ্গে খাবার জন্যে তাঁকে আলাদা করে নেওয়া হল। কর্মকর্তাদের একজন এক ফাঁকে গলা নিচু করে বলল, মিসির আলি সাহেব সন্ধ্যার পর ফ্রি থাকবেন। এক্সকুসিভ ককটেল পার্টি। হুইস্কির মধ্যে ব্লু লেভেল যোগাড় হয়েছে।
মিসির আলি বললেন, আমি তো হুইঙ্কি খাই না।
লাইটার ড্রিংকসও আছে–খুব ভালো ওয়াইন আছে।
আমি মদ্যপান করি না।
কোকা-পেপসিও আছে। কোকা-পেপসি খাবেন।
মিসির আলি সহজ গলায় বললেন, মদের আসরে পেপসি-কোকওয়ালাদের না থাকাই ভালো।
আপনার যে বই আছে তা জানতাম না। বইয়ের কপি কি আছে–একটা কপি আমাকে দেবেন তো।
আমার কাছে কোনো কপি নাই। নিজের কপিও নাই।
আচ্ছা ঠিক আছে–আমি বই যোগাড় করে নেব। আমার জন্যে আমেরিকা থেকে বই আনা কোনো ব্যাপার না। আমার মেয়ে জামাই থাকে আমেরিকায়। ইন্টারনেটে জানিয়ে দিলে নেক্সট উইকে বই এসে যাবে। আপনার জন্যে কি একটা কপি আনব?
না। আমার জন্যে কোনো কপি লাগবে না।
মিসির আলি ভরপেট খাবার খেলেন। আরো এক কাপ কফি খেলেন। প্রফেসর বিখ্যাত মানুষটার সঙ্গে ছবি তুলব, এবং তাঁর অটোগ্রাফ নেব। ছবি সেশন এবং অটোগ্রাফ সেশনও শেষ হল। ফটোগ্রাফারদের ফ্ল্যাশ একের পর এক জ্বলতেই থাকল। মিসির আলি তাঁর মুখ হাসি হাসি করে রাখলেন। যে পূজার যে মন্ত্র। ফটো সেশান পূজার মন্ত্র হল–মুখভর্তি হাসি। মুখ হাসি হাসি করে রাখা যে এমন এক ক্লান্তিকর ব্যাপার তিনি জানতেন না। সেমিনার হলে মিসির আলি যতটা বিরক্ত হয়েছিলেন তারচেয়ে অনেক বিরক্ত হলেন সেমিনার-পরবর্তী কর্মকাণ্ডে।
হোটেল থেকে বের হয়ে তাঁর বিরক্তি কেটে গেল। আকাশে মেঘ করেছে। কার্তিক মাসের ঘোলাটে পাতলা মেঘ না, আষাঢ়ের ঘন কালো মেঘ। মেঘ দেখেই মনে হচ্ছে বৃষ্টি নামবে। বর্ষাকালের বৃষ্টির এক ধরনের মজা, শীতের অপ্রত্যাশিত বৃষ্টির অন্য ধরনের মজা।
বৃষ্টি দেখলে মানুষ উতলা হয় কেন? এরকম চিন্তা করতে করতে মিসির আলি হাঁটতে শুরু করলেন। বৃষ্টি দেখে মন উতলা হবার তেমন কোনো বাস্তব কারণ নেই! ব্যবস্থাটা প্রকৃতি করে রেখেছে। সমস্ত প্রাণিকুলের জিনে কিছু তথ্য দিয়েছে। এই তথ্য বলছে–আকাশ যখন মেঘে ঢেকে যায় তখন তোমরা উতলা হবে। শুধু প্রাণিকুল না। বৃক্ষকুলের জন্যেও একই তথ্য। এর কারণ কী? প্রকৃতি কি আমাদের বিশেষ কিছু বলতে চাচ্ছে যা আমরা ধরতে পারছি না। প্রকৃতি কি চায় বর্ষা বাদলায় আমরা বিশেষ কিছু ভাবি? অন্য ধরনের চিন্তা করি। বর্ষা বাদলার সঙ্গে সৃষ্টি সম্পর্কিত কিছু কি জড়িয়ে আছে? শুধু মানুষকে সরাসরি কিছু বলে না। সে কথা বলে ইঙ্গিতে। সেই ইঙ্গিত বোঝাও কঠিন।
বাসায় ফিরে মিসির আলি স্বস্তি পেলেন। ইয়াসিন চলে এসেছে। বাসায় তালা খুলে ঢুকে পড়েছে। তালা খোলার ব্যাপারে এই ছেলেটির দক্ষতা ভালো। মিসির আলি সদর দরজার জন্যে তিন শ টাকা খরচ করে একটা আমেরিকান তালা লাগিয়েছিলেন। তালার প্যাকেটে লেখা ছিল—বাৰ্গলার প্রাফ লক। সেই কঠিন তালা এগোরো-বারো বছরের একটা ছেলে মাথার ক্লিপ দিয়ে খুঁচিয়ে কীভাবে খুলে ফেলে সেটা এক রহস্য। একই সঙ্গে চিন্তারও বিষয়।
ইয়াসিন যখন কাজ করে–মন লাগিয়ে কাজ করে, এবং অত্যন্ত দ্রুত কাজ করে। ঘর ঝাঁট দেওয়া হয়েছে। পানি দিয়ে মোছা হয়েছে। বিছানার চাদর বদলে নতুন চাদর টানটান করে বিছানো হয়েছে। দেয়াল ঘড়িতে ব্যাটারি লাগানো হয়েছে এবং ঘড়ি চলছে। ঠিক টাইম দিচ্ছে। ইয়াসিন যেহেতু ঘড়ির টাইম দেখতে পারে না কাজেই ধরে নেওয়া যায়–ঘড়ি নিয়ে দোকানে গিয়ে ব্যাটারি লাগিয়ে এনেছে। মিসির আলি সাহেবের পড়ার টেবিলও গোছানো। টেবিলের ওপর চকচকে পাঁচ শ টাকার একটা নোট–কলম দিয়ে চাপা দেওয়া।