বদরুল সাহেব চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, আপনি কী করেন এটাই এখনো জানলাম না। আপনি করেন কী?
মিসির আলি বললেন, কিছু করি না।
রিটায়ারও করি নি। মাস্টারি করতাম। চাকরি চলে গিয়েছিল।
বলেন কি আপনার চলে কীভাবে?
কয়েকটা বই লিখেছিলাম–সেখান থেকে রয়েলটি পাই। এতে কষ্টটষ্ট করে চলে যায়।
বই বিক্রি বন্ধ হয়ে পেলে কী করবেন?
তখন খুব সমস্যার পড়ব।
ফতের কাছে শুনলাম, বিয়েও করেন নি।
ঠিকই শুনেছেন। এতে একদিক দিয়ে সুবিধা হয়েছে–টাকা পয়সার সাপ্লাই বন্ধ হয়ে গেলে রাস্তায় নেমে পড়ব। একা মানুষের জন্যে বিরাট শহরে বাসস্থান ছাড়া বাস করা তেমন কঠিন না।
বদরুল সাহেব বিস্মিত গলায় বললেন, রাতে ঘুমাবেন কোথায়? বাথরুম করবেন কোথায়?
মিসির আলি হাসিমুখে বললেন, একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
বদরুল সাহেব উঠে দাঁড়ালেন, ইতস্তত করে বললেন—বাড়ি ছাড়ার আগে আমাকে এক মাসের নোটিশ দিতে হবে।
মিসির আলি বললেন, নোটিশ অবশ্যই দেব। আপনি চা না খেয়ে উঠে যাচ্ছেন।
চা খাব না।
মিসির আলির মনে হল এই ভদ্রলোক তার ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। তিনি এখন মিসির আলিকে ভাড়াটে হিসেবে দেখছেন না–একজন ছিন্নমূল মানুষ হিসেবে দেখছেন। ছিন্নমূল মানুষের সঙ্গে কোনো বাড়িওয়ালা কখনো গল্পগুজব করে সময় নষ্ট করবে না। মিসির আলির মনে হল—খুব শিগগিরই তিনি বাড়ি ছাড়ার নোটিশও পাবেন। যে ভাড়াটের টাকা পয়সার সাপ্লাইয়ের ঠিক নেই তাকে কোনো বাড়িওয়ালা রাখবে না।
বদরুল সাহেব চলে যাওয়ায় মিসির আলির জন্যে খানিকটা সুবিধা হল। সেমিনারে যাওয়া যাবে। শুধু সেমিনার না, তিনি ঠিক করলেন-বিয়ের যে নিমন্ত্রণটা পেয়েছেন, সেখানেও যাবেন। প্লেট ভর্তি করে পোলাও নেবেন। হাতাহাতি করে রেজালা নেবেন। একগ্লাস বোরহানি থাকা সত্ত্বেও আরো একগ্লাস নিতে গিয়ে তাড়াহুড়া করে গ্লাস ফেলে পাশের জনের জামাকাপড় ভিজিয়ে দেবেন। নগরে বাস করতে হলে নাগরিক মানুষ হতে হয়। মিসির আলি ঠিক করলেন, তিনি পুরোপুরি নাগরিক মানুষ হবার একটা চেষ্টা চালাবেন।
সেমিনারের বিষয়বস্তু বয়ঃসন্ধিকালীন মানসিক জটিলতা। গেস্ট স্পিকার অধ্যাপক স্ট্রাইনার এসেছেন আমেরিকা থেকে। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিদ্যার অধ্যাপক। তিনি সস্ত্রীক দশ দিনের জন্যে এসেছেন। বাংলাদেশে একদিন থেকে চলে যাবেন নেপালের পোখরায়। দুদিন ছুটি কাটয়ে যাবেন নয়াদিল্লি। নয়াদিল্লির আরেকটি সেমিনার শেষ করে ইজিপ্ট হয়ে দেশে ফিরবেন। প্রফেসর স্টাইনারের মূল স্পনসর দিল্লির মেডিকেল এসোসিয়েশন। বাংলাদেশ ফাঁকতালে ঢুকে পড়েছে। যেহেতু নেপাল যাবার পথে বাংলাদেশের ঢাকায় একদিনের জন্যে ট্রানজিট নিতেই হবে কাজেই তাকে ধরা হল একটা দিন বাংলাদেশকে দিতে হবে। সেমিনারের গেস্ট স্পিকার হবার বিনীত অনুরোধ। তাঁকে সামান্য সম্মানী দেওয়া হবে। ঢাকায় একরাত তাকে রাখা হবে ফাইভ স্টার হোটেলে।
বিদেশী বিশেষজ্ঞরা এই জাতীয় প্রস্তাবে সহজেই রাজি হয়ে যান। প্রফেসর স্টাইনারও সানন্দে রাজি হলেন। আরেকটা দেশ দেখা হলে মন্দ কি? প্রফেসর রাজি হওয়া মাত্রই ঢাকা মেডিকেল এসোসিয়েশনের কর্তব্যক্তিরা ছোটাছুটি শুরু করলেন। বিদেশী বিশেষজ্ঞ এলেই হবে না, প্রধানমন্ত্রীকে আনতে হবে। প্রধানমন্ত্রী মানেই পাবলিসিটি। টিভিতে বিরাট কভারেজ। প্রধানমন্ত্রীর আগমনের কারণে মেডিকেল এসোসিয়েশনের কর্তব্যক্তিদের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে ঘোরাঘুরির বাড়তি সুযোগ। মোটামুটি নিরুত্তাপ ডাক্তারদের জীবনে কিছু উত্তাপ। সেমিনার উপলক্ষে খাওয়াদাওয়া। যেহেতু বিদেশী বিশেষজ্ঞ গেস্ট আসছেন তাঁর সম্মানে রাতে একটা এক্সক্লুসিভ ককটেল পার্টি। প্রধান বিষয় প্রধানমন্ত্রীর আগমন। মানের ক্রম অনুসারে ককটেল পার্টি, সেমিনারের খাওয়াদাওয়া, বিদেশী বিশেষজ্ঞকে নিয়ে শহর পর্যটন। সেমিনারটা ফাও!
প্রায় এক সপ্তাহ কর্মকর্তারা ছোটাছুটি করলেন। তাঁরা পুরোপুরি হতাশ হয়ে গেলেন যখন জানা গেল। এই সময় প্রধানমন্ত্রী থাকবেন না। তিনি বিদেশে যাচ্ছেন। এই তারিখে প্রেসিডেন্টকেও পাওয়া যায় কি না সেই চেষ্টা চলতে থাকল। চারটি কমিটি করা হল। একটা হল এন্টারটেইনমেন্ট কমিটি। এই কমিটি সন্ধ্যাবেলায় একটি স্যা অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে। আরেকটি কমিটি হল ফুড কমিটি! এই কমিটির দায়িত্ব সেমিনারের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করা। তৃতীয় কমিটি দেখছে ককটেল পার্টি। খুবই সেনসেটিভ বিষয়। কাকে দাওয়াত দিতে হবে কাকে দাওয়াত দিতে হবে না। এটা চিন্তাভাবনা করে ঠিক করতে হবে। নানান ধরনের ড্রিংকের ব্যবস্থা রাখতে হবে যাতে বোতলের সংখ্যা এবং বৈচিত্র্য দেখে অধ্যাপক এবং অধ্যাপকপত্নীর চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। মূল সেমিনার বিষয়ে কোনো কমিটি হল না। এটা এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না। প্রফেসর স্টাইনারকে পাওয়া গেছে এটাই গুরুত্বপূর্ণ। সেমিনারে বাংলাদেশ থেকে দুটা পেপার পড়া হবে। পেপার দুটা তৈরি আছে–ব্যস। আর কি।
সেমিনার শেষ হয়েছে। দু ঘণ্টার সেমিনার শেষে অতিথিদের জন্যে লাইট রিফ্লেসমেন্ট। সাংবাদিক এবং অতিথিরা খাবারের টেবিলে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। তাদের দেখে মনে হচ্ছে দীর্ঘদিন তারা অনশনে ছিলেন। আজ অনশন ভঙ্গ করেছেন। কে কার আগে প্লেট নেবেন তা নিয়ে ধাক্কাধাব্ধি চলছে। খাবার ভালো। ফাইভ স্টার হোটেলের খাবার, পাঁচশ টাকা প্লেটের রিফ্লেসমেন্ট খারাপ হবার কারণ নেই।