ফতে সিগারেট ধরাল। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঠাণ্ডাও বাড়ছে। গলা থেকে মাফলার খুলে সে কান ঢাকল। মিসির আলি সাহেবের ঘরে বাতি জুলছে। বুড়ো এখনো জেগে গুন্টুর গুটুর করে বই পড়ছে। একটা মানুষ দিনরাত বই পড়ে কীভাবে কে জানে? এত জ্ঞান নিয়ে কী হবে? মৃত্যুর পর সব জ্ঞান নিয়ে কবরে যেতে হবে। যে মাথায় গিজগিজ করত। জ্ঞান সেই মাথার মগজ পিঁপড়া খেয়ে ফেলবে। শরীরে ধরবে পোকা। ফতে সব মানুষকে চট করে বুঝে ফেলে এই মানুষটাকে এখনো বোঝা যাচ্ছে না। কখনো মনে হয় মানুষটা বোকা। শুধু বোকা না-বোকাদের উজির-নাজির। আবার কখনো মনে হয় লোকটী মহাচালাক। সে আসলে চালাকদের উজির-নাজির। তার কাজের একটা ছেলে আছে তার সাথে যেভাবে কথা বলে মনে হয় নিজের ছেলের সঙ্গে কথা বলে। একদিন সে বাড়িতে উঁকি দিয়ে দেখেছে দুজন পাশাপাশি বসে ভাত খাচ্ছে। আরেক দিনের কথা ফতের স্পষ্ট মনে আছে। সে গিয়েছে বাড়ি ভাড়া আনতে। মিসির আলি সাহেব তখন নিজেই চা বানাচ্ছিলেন। ফতেকে বলল, চা খাবে? ফতে বলল, না। এখন কাজের ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, ইয়াসিন চা খাবি? ইয়াসিন গাড়ীর গলায় বলল, হা। চিনি বেশি দিয়েন। ফতে অবাক হয়ে দেখল মিসির আলি কাজের ছেলের জন্যে চা বানিয়ে আনছেন।
লোকটা নাকি অনেক জটিল বিষয় জানে। কী জানে কতটুকু জানে তা ফতের দেখার ইচ্ছা। জটিল বিষয় ফতে নিজেও জানে। তাকে কেউ চিনে না। কারণ সে বলতে গেলে–এক বাড়ির কাজের লোক, বেবিট্যাক্সির ড্রাইভার। তার কথা কে বিশ্বাস করবে? সে যদি বলে এই দুনিয়ার জটিল বিষয় আমি যত জানি আর কেউ এত জানে না। তা হলে কেউ কি তা বিশ্বাস করবে? কেউ বিশ্বাস করবে না। কারণ সে মিসির আলির মতো জ্ঞানী না। সে ইউনিভার্সিটিতে পড়ানো দূরে থাকুক-নিজে ইউনিভার্সিটির ধারেকাছে কোনোদিন যায় নাই। যাওয়ার ইচ্ছাও নাই। সে যা শিখেছে নিজে নিজে শিখেছে। সবার ওস্তাদ থাকে তার কোনো ওস্তাদ নেই।
ফতের ইচ্ছা করে মিসির আলিকেও শাস্তি দিতে। জ্ঞানী লোকের জন্য জ্ঞানী শাস্তি। মনে কষ্ট দেওয়া শান্তি। এই লোকটা কিসে কষ্ট পাবে তা আগে বের করতে হবে। মানুষ হল মাছধরা জালের মতো। মাছধরা জালে দুই একটা সুতা ছেড়া থাকে। মানুষের জালেও সেরকম ছেড়া সুতা আছে। সুতার ছেড়া জায়গাটা হল তার দুর্বল জায়গা। আক্রমণ করতে হয় দুর্বল জায়গায়। ফতের ধারণা মিসির আলির দুর্বল জায়গা তার জ্ঞান। ধাক্কাটা দিতে হবে জ্ঞানে। প্রমাণ করে দিতে হবে এত আগ্রহ করে যে জ্ঞান অর্জন করা হচ্ছে সেই জ্ঞান ভুল। কাজটা কঠিন, তবে খুব কঠিন না।
ফজলু মিয়াকেও শাস্তি দিতে হবে। আজ সে চোখের ইশারায় তার মেয়েকে সরে যেতে বলল। যেন ফতে কোনো দুষ্ট লোক! দুষ্ট লোকের হাত থেকে মেয়েকে রক্ষা করার চেষ্টা। ফজলু ঠিকই ভেবেছে ফতে মিয়া দুষ্ট লোক। কিন্তু কী রকম দুষ্ট লোক তা সে জানে না। জানার কথাও না। ফতে নিজেই জানে না, সে কীভাবে জানবে? ফজলু ভেবেছে ফিতে তার চোখের ইশারা দেখতে পায় নি। ফতে ঠিকই দেখেছে। কাজেই ফজলু মিয়াও শাস্তি পাবে। তার শাস্তি আবার হবে অন্য রকম। শাস্তি হল জামার মতো। সাইজ হিসাবে জামা বানাতে হয়। কাঁধের পুট ঠিক থাকতে হয়, হাতার মুহুরি ঠিক থাকতে হয়, কলার ঠিক থাকতে হয়। যে কোনো শাস্তিই হতে হয় মাপমতো।
ফতে সিগারেট ধরাল। শীত আরো বেড়েছে। কুয়াশা বাড়ছে। কুয়াশায় মাথার মাফলার ভিজে যাচ্ছে। তার জেগে বসে থাকার কথা-সে নিজের ঘরে জেগে বসে। থাকতে পারে। তা না করে সে আগের জায়গাতেই বসে রইল। সে হালকাতাবে শিন্স দিচ্ছে এবং পা নাচাচ্ছে। তাকে আনন্দিত মনে হচ্ছে।
লুনা কাঁদতে শুরু করেছে। কেঁদেই যাচ্ছে। কেঁদেই যাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফতের ডাক পড়বে। ফতে অপেক্ষা করতে লাগল। এখনো ডাক আসছে না। মেয়ের মা মেয়েকে শান্ত করার চেষ্টা করছে! লাভ হচ্ছে না। আচ্ছা এমন কি হবে যে বিরক্ত হয়ে লুনাকে কোলে নিয়ে তার মা বারান্দায় এল তারপর বিরক্ত হয়ে দোতলা থেকে মেয়েকে ফেলে দিল?
হওয়া বিচিত্র কিছু না। এই দুনিয়ায় অনেক বিচিত্র ব্যাপার ঘটে।
দাওয়াতের কার্ড
বদরুল সাহেবের হাতে দাওয়াতের একটা কার্ড। দাওয়াতের কার্ডটা মিসির আলির। বদরুল সাহেবের ঠিকানায় এসেছে, তিনি নিজেই কার্ড দিতে এসেছেন। বিয়ের নিমন্ত্রণপত্র। মিসির আলি বললেন, আপনার আসার প্রয়োজন ছিল না। কার্ডটা কাউকে দিয়ে পাঠিয়ে দিলেই হত।
বদরুল সাহেব বললেন, আপনার সঙ্গে তো কথা হয় না, ভাবলাম এই সুযোগে দুটা কথা বলে আসি। ঢাকা শহরে ভাড়াটে আর বাড়িওয়ালার মধ্যে সুসম্পর্ক হয় না। আমি চাই সুসম্পর্ক।
মিসির আলি বললেন, আপনি বসুন।
বদরুল সাহেব বললেন, বসব না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ কথা বলে চলে যাব। নানান ব্যস্ততায় থাকি। বসে গল্পগুজব করার মতো সময় কোথায়? আমার বাড়িতে আপনার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো?
জি না।
অসুবিধা হলে সরাসরি আমাকে বলবেন। আগে ফতেকে বললেই হত। এখন আবার ফতে দোকান দিয়েছে। আলাদা বাসা নিবে।
আমার কোনো সমস্যা হলে আমি আপনাকেই বলব।
আপনার কাজের ছেলেটাকে এক কাপ চা দিতে বলুন। চা খেয়েই যাই। নিজের বাড়ির চায়ের চেয়ে অন্যের বাড়ির চা খেতে সব সময়ই ভালো লাগে।
মিসির আলি খানিকটা শঙ্কিত বোধ করলেন। খুব যারা কাজের মানুষ তারা মাঝে মাঝে গা এলিয়ে দেয়। এই ভদ্রলোক মনে হচ্ছে গা এলিয়ে দিতেই এসেছেন। মিসির আলির হাতে কোনো কাজকর্ম নেই–তারপরেও আজ তিনি সামান্য ব্যস্ত। ঢাকা মেডিকেল এসোসিয়েশনের একটা সেমিনারে যাবেন বলে ঠিক করেছেন। সবকিছু থেকে তিনি নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছেন। এই কাজটা ঠিক হচ্ছে না।