সন্ধ্যা মিলিয়েছে। জোয়ার্দার বারান্দায় বসে আছেন। চা এবং সিগারেট শেষ হয়েছে। দুপুরে লাঞ্চ করেননি বলে ক্ষুধা বোধ হচ্ছে। আজ মনে হয় ৯টার আগেই খেতে হবে। এর মধ্যে রান্না হবে কি না কে জানে।
পুফিকে কোলে নিয়ে অনিকা বারান্দায় ঢুকল। জোয়ার্দারের সামনে বসতে বসতে উজ্জ্বল মুখে বলল, এমন অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে বাবা, শুনলে তুমি চমকে উঠবে।
কী ঘটনা?
পুফি যাতে বাথরুম করতে পারে এই জন্যে আমি একটা প্লাস্টিকের থালায় বালি দিয়ে উত্তর দিকের বারান্দায় রেখেছি। এতেই কাজ হয়েছে। সে এখন তার বাথরুমে বাথরুম করে।
ভালো।
অদ্ভুত ব্যাপার না বাবা?
হুঁ।
আমার কী ধারণা জানো বাবা? আমার ধারণা, বিড়ালদের ভাষা আছে। তারা এ ভাষায় নিজেদের সঙ্গে কথা বলে।
হুঁ।
তুমি শুধু হুঁ হুঁ করছ, কথা বলছ না।
শরীরটা ভালো লাগছে না।
পুফিকে একটু কোলে নেবে? একটু কোলে নাও না, প্লিজ। ও তোমার কোলে যেতে চাচ্ছে। দেখো না, কেমন করুণ চোখে তাকিয়ে আছে।
জোয়ার্দার দেখলেন বিড়ালটা সত্যি তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে।
বিড়ালটার ডান চোখের ওপর কালো দাগ। তিনি যে বিড়ালটা দেখেছেন তার চোখের ওপর দাগ ছিল কি না। তিনি মনে করতে পারলেন না।
বাবা!
হুঁ।
আজ ক্লাসে খুব লজ্জার একটা ঘটনা ঘটেছে। বলব?
হুঁ।
মাকে বলেছিলাম। মা বলল, এ ধরনের পচা গল্প যেন আমি কখনো না করি। তুমি শুনবে?
তোমার মা যখন নিষেধ করেছে তখন থাক।
আমার খুব বলতে ইচ্ছা করছে।
তাহলে বলো।
আমাদের ইংরেজি মিস আজ ক্লাসে ঢুকেই শব্দ করেছেন। আমরা সবাই চেষ্টা করেছি না হাসতে। তারপর মিসের করুণ মুখ দেখে হেসে একে অন্যের গায়ে গড়িয়ে পড়েছি।
জোয়ার্দার বললেন, ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম না। শব্দ করেছেন মানে কী।
খারাপ শব্দ।
জোয়ার্দার অবাক হয়ে বললেন, শব্দের আবার ভালো খারাপ কী?
অনিকা বলল, বাবা, তুমি এত বোকা কেন? পুফির যত বুদ্ধি আছে তোমার তাও নেই। ম্যাডাম Fart করেছেন।
তার মানে কী?
অনিক বলল, এর মানে কী বলতে পারব না। তোমাকে ডিকশনারি এনে দিচ্ছি। ডিকশনারিতে দেখো।
অনিকা বাবার কোলে ইংরেজী ডিকশনারি দিয়ে গেল। জোয়ারদর্দার ডিকশনারি খুললেন। এই শব্দটা verb হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আবার Noun হিসাবে ব্যবহার করা হয়। verb হলো To let air from the bowels come out through the anus.
Noun হলো An unpleasant, boring and stupid person. জোয়ার্দারের মনে হলো তিনি এ রকমই একজন। বোরিং এবং স্টুপিড। তিনি পরপর দুবার বললেন, I am a fart. I am a big Fart.
রাতে জোয়ারদার একা খেতে বসলেন। খেতে বসে লক্ষ্য করলেন সবার মধ্যে গোপন একধরনের ব্যস্ততা। জোয়ারদার বললেন, তোমরা খাবে না?
সুলতানা বললেন, তোমাকে বলতে ভুলে গেছি। রঞ্জু আরেকটা নতুন গাড়ি কিনেছে। নাম আলফ্রাড। ৪০ লাখ টাকা দাম।
জোয়ারদার বললেন, ওর নতুন গাড়ি কেনার সঙ্গে তোমাদের না খাওয়ার কী সম্পর্ক?
রঞ্জু গাড়িটা পাঠিয়ে দিয়েছে আমাদের নিয়ে যাওয়ার জন্যে। গাড়ি নিয়ে লং ড্রাইভে যাবে।
ও, আচ্ছা।
আমরা কুমিল্লা চলে যাব। রাতে থাকব কুমিল্লা বার্ডে। ভোরবেলা ঢাকা রওনা হব। তুমি নিশ্চয়ই আমাদের সঙ্গে যাবে না।
না।
আমি কাজের মেয়ে দুটিকেও নিয়ে যাচ্ছি। সকাল ৮টা বাজার আগেই ঢাকা ফিরব। তোমার ব্রেকফাস্টের সমস্যা হবে না।
আচ্ছা।
জোয়ার্দার লক্ষ করলেন, কাজের মেয়ে দুটি বিপুল উৎসাহে সাজগোজ করছে। সুলতানা রাত কাটানোর জন্যে বাইরে কোথাও গেলেই কাজের মেয়ে দুটিকে নিয়ে যান।
মেয়ে দুটির বয়স ষোল, সতেরো। দুজন যমজ বোন। আগে নাম ছিল হাবীব, হামিদা। সুলতানা নাম বদলে রেখেছেন, তুহিন—তুষার। এরা সারাক্ষণ সাজগোজ নিয়ে থাকে। মেয়ে দুটি জন্ম থেকেই রূপ নিয়ে এসেছে। সুলতানা ঘষে মেজে এদের প্রায় নায়িকা বানিয়ে ফেলেছেন। লাক্স চ্যানেল আই সুপার ষ্টারে পাঠালে থার্ড বা ফোরথ হয়ে যেতে পারে।
অপরিচিত কেউ এলে সুলতানাকে জিজ্ঞেস করেন, এরা আপনার বোন নাকি?
সুলতানা চাপা আনন্দ নিয়ে বলেন, এই দুটাই আমার কাজের মেয়ে। এই তোরা হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? গেস্টকে চা দিবি না?
গেস্ট খুবই লজ্জা পান। গেস্টদের লজ্জা সুলতানা উপভোগ করেন।
সুলতানা রাতে যখন থাকেন না, তুহিন-তুষারকে রেখে যেতে শঙ্কা বোধ করেন। পুরুষ মানুষকে বিশ্বাস করা আর শকুন বিশ্বাস করা একই। শকুন মারা গরু দেখলে ঝাঁপিয়ে পড়বে। পুরুষও মেয়েমানুষ দেখলে ঝাঁপিয়ে পড়বে। মৃত মেয়ে মানুষ দেখলেও ঝাঁপ দিবে।
রাতের খাবার শেষ করে ছবি দেখতে বসে জোয়ারদার লক্ষ্য করলেন বিড়ালটা তার চেয়ার ঘেঁষে বসে আছে। ওই দিনের সেই বিড়াল, এতে কোনো সন্দেহ নেই। একটা ছোট্ট প্ৰভেদ অবশ্য আছে। অনিকার বিড়ালটার ডান চোখের ওপর শাদা দাগ। এটার বা চোখের ওপর কালো শাদা। এমনকি হতে পারে এই বিড়ালটা অনিকার বিড়ালের যমজ? তুহিন তুষারের মত এরাও যমজ বোন। অনিকার বিড়ালের নাম পুফি। এটার নাম দেওয়া যেতে পারে কুফি।
জোয়ারদার বললেন, এই কুফি। কুফি।
বিড়াল ঘড়ি ঘড়ি শব্দ করল। নাম পছন্দ হয়েছে কী হয়নি বোঝা গেল না।
বিড়াল রহস্য নিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করতে হবে। হুটহাট চিন্তায় কাজ হবে না। জোয়ার্দার ছবিতে মন দিলেন। মন বসছে না, তবুও জোর করে তাকিয়ে থাকা। ওয়েস্টার্ন ছবি। বন্দুক পিস্তলের ছড়াছড়ি। অনিকের ঘর থেকে হাসির শব্দ শোনা গেল! এই শব্দে জোয়ার্দারের শরীর প্রায় জমে গেল। হাসির শব্দ তাঁর পরিচিত। জামালের হাসি। অনেক দিন পর খালি বাড়ি পেয়ে জামাল এসেছে। মাঝখানে অনেক দিন তিনি জামালকে দেখেন। নি। হয়ত আজ আবার দেখলেন।