রাত ৮টা বাজে। বাড়িতে কেউ নেই বলেই মনে হয়, আগেভাগে খিদে লেগেছে। তিনি ঠাণ্ডা খাবার খেতে পারেন না। মাইক্রোওয়েভে খাবার গরম করার বিষয়টাও জানেন না। নানান বোতাম টিপা টিপি করতে হয়। টাইমার সেট করতে হয়। এর চেয়ে ঠাণ্ডা খাবার খাওয়াই ভালো। খাওয়ার টেবিলের কাছে গিয়ে তাকে থমকে দাড়াতে হলো। মাংসের বাটি উপুড় হয়ে আছে। টেবিলে মাংস ছড়ানো ভাতের বাটির ঢাকনা খোলা। প্লেটে মাংসের ঝোলমাখা বিড়ালের পায়ের ছাপ। ডালের বাটিতে মৃত তেলাপোকা ভাসছে। যে তেলাপোকা নিয়ে পুফি খেলছিল তাকেই এনে ডালের বাটিতে ফেলেছে। বদ বিড়ালের এই কান্ড।
জোয়ার্দার ফলের ঝুড়ি থেকে একটা আপেল নিয়ে টিভির সামনে বসলেন। ডিভিডির বোতাম চাপতেই ছবি শুরু হলো। মনে হয়, ভূত প্রেতের কোনো ছবি।
কবর খুঁড়ে কফিন বের করা হচ্ছে। গভীর রাত, কবরের পাশে লণ্ঠনের আলো ছাড়া কোনো আলো নেই। কবর খুঁড়ছে রূপবতী তরুণী এক মেয়ে। মেয়েটার মাথার চুল সোনালী।
জোয়ার্দার আগ্রহ নিয়ে ছবি দেখছেন। বিড়ালটাও তার মতো অগ্রহ নিয়ে ছবি দেখছে। সে বসেছে জোয়ার্দারের ডান পায়ের কাছে। ইচ্ছে করলেই প্ৰচণ্ড লাথি মেরে বিড়ালকে উচিত শিক্ষা দেওয়া যায়। তিনি শাস্তি দিচ্ছেন না। জমা করে রাখছেন। সব শাস্তি একসঙ্গে দেয়া হবে।
সুলতানা ফিরুক, স্বচক্ষে বিড়ালের কীর্তিকলাপ দেখুক, তারপর শাস্তি। শাস্তি হবে দীপান্তর। বস্তায় ভরে দূরে কোথাও নিয়ে ফেলে দিয়ে আসা।
বস্তা-শাস্তির কিছু নিয়ম কানুন আছে। বিড়ালের সঙ্গে গোটা দশেক ন্যাপিথেলিন দিয়ে বস্তার মুখ বন্ধ করতে হয়। ন্যাপথলিনের কড়া গন্ধে বিড়ালের ঘাণশক্তি সাময়িক নষ্ট হয়। তখন তাকে দূরে ফেলে দিয়ে এলে সে আর গন্ধ স্ট্রকে স্ট্রকে ঘরে ফিরতে পারে না।
কলিংবেল বাজছে। জোয়ার্দার উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর সঙ্গে বিড়ালও উঠে দাঁড়াল। গায়ের আড়মোড়া ভাঙিল। হাই তুলল, তারপর ও লাফ দিয়ে টিভি সেটের ওপর বসে পড়ল।
জোয়ার্দার দরজা খুললেন। অনিক বিড়াল হাতে দাঁড়িয়ে আছে। বিড়ালের গালের সঙ্গে তার গাল লাগানো। এর মানে কী? অনিকা বিড়াল নিয়েই গিয়েছিল? তাহলে টিভির ওপর যে বিড়ালটা বসে আছে, সেটা কো থেকে এসেছে?
জোয়ার্দার দৌড়ে বসার ঘরে এলেন। সেখানে কোনো বিড়াল নেই। তিনি প্রতিটি ঘর খুঁজলেন, বিড়াল নেই।
সুলতানা বললেন, কী খুঁজছ?
কিছু না।
টেবিলে খাবার ছড়িয়েছ কেন?
জোয়ার্দার হতাশ চোখে তাকিয়ে রইলেন। কিছু বললেন না।
সুলতানা বললেন, কাজটা কি তুমি আমার উপর রাগ করে করলে?
তা-না।
তুমি না যাওয়ায় রঞ্জু বেশ মন খারাপ করেছে। মেয়ের জন্মদিন উপলক্ষে সে আমাকে একটা শাড়ি দিয়েছে, তোমাকে একটা গরম চাদর দিয়েছে। পছন্দ হয়েছে কি-না দেখি।
পছন্দ হয়েছে।
না দেখেই বললে পছন্দ হয়েছে। গায়ে দিয়ে দেখ।
জোয়ার্দার চাদর গায়ে দিয়ে দরজা খুলে হঠাৎ বের হয়ে গেলেন। এমনও তো হতে পারে বেড়ালটা নিচে আছে। প্রতিটি ফ্ল্যাট বাড়ির গ্যারেজে কিছু বিড়াল থাকে। ড্রাইভারদের ফেলে দেয়া খাবার খেয়ে এরা বড় হয়।
গ্যারেজে কোনো বিড়াল পাওয়া গেল না।
এজি অফিস হলো ঘুষের কারখানা
জোয়ার্দার এজি অফিসে কাজ করেন। তার পোস্টের নাম অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস অফিসার।
এজি অফিস হলো ঘুষের কারখানা। অর্থমন্ত্রী বা রাজস্ব বোর্ডের প্রধানের নিজের চেক পাস করতে হলেও ঘুষ দিতে হয়। টাকার পরিমাণের ওপর ঘুষের অঙ্ক নির্ধারিত। এজি অফিসের লোকজন অঙ্কে পাকা।
জোয়ার্দার সাহেব এই অফিসে হংস মধ্যে বক যথা, তিনি ঘুষ খান না। একবারই তিনি কিছুক্ষণের জন্যে ঘুষ নিয়েছিলেন- লাল রঙের একটা ফাউনটেনপেন। এই কলমের বিশেষত্ব হচ্ছে, রাতে কলমের গা থেকে আলো বের হয়। ঘরে বাতি না থাকলেও এই কলম দিয়ে লেখা যায়। অনিক এমন একটা কলম পেলে আনন্দে লাফালাফি করবে ভেবেই তিনি সহকমীর কাছে থেকে কলামটা নিলেন। সহকমীর নাম খালেক। সে বলল, স্যার, ফাইলটা রেখে গেলাম পাস করে দেবেন। পাটি ঝামেলায় আছে।
বিকেল ৪টা ২১ মিনিট পর্যন্ত ঝামেলায় পড়া পার্টির ফাইল হাতে নিয়ে বসে রইলেন। দুপুরে লাঞ্চ খেলেন না। বিকেল ৪টা ২৬ মিনিটে তিনি খালেককে ফাইল এবং কলম ফেরত দিলেন।
খালেক বলল, স্যার! আপনি আজিব মানুষ। কলামটা আপনি রেখে দেন, ফাইলে সই করার দরকার নাই। আমি অন্য ব্যবস্থা করব।
জোয়ার্দার বললেন, না।
খালেক নিজের মনে আবারও বলল, আজিব আদমি।
জোয়ার্দারকে আজব মানুষ ভাবার কোনো কারণ নেই। তাঁর চরিত্রে অদ্ভুত কিছু নেই। অফিস থেকে বেইলি রোডের বাসায় ফেরেন হেঁটে। বাসায় ফিরেই গোসল সেরে বারান্দায় বসে এক কাপ চা খান। চায়ের সঙ্গে দিনেয়। তৃতীয় সিগারেটটি খেতে হয়।
চা নিয়ে সুলতানা আসেন এবং প্রতিদিনের মতো জিজ্ঞেস করেন, চায়ের সঙ্গে কিছু খাবে? বাসায় দিনাজপুরের চিড়া আছে। চিড়া ভেজে দেব?
তিনি বলেন, না।
মাখন মাখিয়ে টোস্ট বিসকিট দেব?
না।
রাতে কী খাবে?
যা রান্না হবে তাই খাব।
সুলতানা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলেন (সব দিন না, মাঝে মাঝে), তোমাকে বিয়ে না করে একটা যন্ত্র বিয়ে করলে আমার জীবনটা সুখের হতো। যন্ত্রে একবার চাবি দিয়ে দিলাম। যন্ত্র, তার মতো চলছে। আমাকে কিছু করতে হচ্ছে না।
সুলতানা লম্বা বাক্যালাপের দিকে গেলেই জোয়ার্দার সিগারেট ধরান। কথার পিঠে কথা বলার অভ্যাস জোয়ার্দারের নেই।