হাল ছেড়ে দেয়া ছাড়া আমি কি আর করতে পারি।
আমি দুজন জোয়ার্দারকে দেখলাম। এদের চেহারা এক, নাম এক, এমন কি টেলিফোন নাম্বার এক কিন্তু এই দুজন সম্পূর্ণ আলাদা। একজন বিয়ে করেছেন তার একটি মেয়ে আছে। মেয়েটির একটি পোষা বিড়াল আছে। বিড়ালটার নাম পুফি।
অন্যজন চিরকুমার। তবে তারও একটি বিড়াল আছে। বিড়ালটার নামও কুফি।
বরকতউল্লাহ নামের একজনকে আমি দেখলাম তারও মনে হয় দুটি সত্তা। এক জায়গায় তিনি মৃত অন্য জায়গায় তিনি জীবিত।
এই উদ্ভট হাস্যকর ব্যাপার কল্পকাহিনীর জন্যে ঠিক আছে। আমার জন্যে ঠিক নেই। আমি কল্পকাহিনীর কোনো চরিত্র না।
মিসির আলি স্যারুকে জিজ্ঞেস করলাম, স্যার আমি কি পাগল হয়ে গেছি?
স্যার বললেন, এখনো হও নি। তবে সম্ভাবনা আছে।
সম্ভাবনা যে আছে তা আমার মত কেউ জানে না। জোয়ার্দারের সঙ্গে আমার বিয়ের পাকা কথা হয়েছিল তারপর কুৎসিত অজুহাতে বিয়ে ভেঙ্গে যায়। তখন একবার আমি পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। লোক লজ্জার ভয়ে দেশে আমার কোনো চিকিৎসা করা হয় নি। আমাকে ইন্ডিয়ার রাঁচিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
কাজেই পাগলামীর বীজ আমার মধ্যে আছে। এটা সুপ্ত অবস্থায় থাকে, কখনো কখনো জাগে।
আমি আমার ব্রেইনের সিটি স্কেন করিয়েছি। মস্তিষ্কের কিছু জায়গায় অতিরিক্ত কর্ম ব্যস্ততা (super activity) দেখা গেছে। মৃগীরোগীদের মধ্যে এ রকম দেখা যায়। আমার কি বিশেষ কোনো ধরনের মৃগী রোগ হয়েছে? যখন রোগের আক্রমন হয় তখন আমি অন্য জোয়ার্দারকে দেখতে পাই?
আমি মাঝে মাঝেই এজি অফিসে যাই। কখনো সেখানে দেখি বরকতউল্লাহ সাহেব বেঁচে আছেন কখনো দেখি বরকতউল্লাহ সাহেব বেঁচে নাই। দুটি সম্পূৰ্ণ আলাদা এজি অফিস।
মিসির আলি স্যার বললেন, তুমি যে এজি অফিসে বরকতউল্লাহ জীবিত সেখান থেকে একটা খবরে কাগজ আনবে এবং যেখানে বরকতউল্লাহ সাহেব মৃত সেখান থেকে একটা খবরের কাগজ আনবে।
আমি তা করেছি। দেখা গেছে একটা খবরের কাগজ মিরর ইমেজ। পুরোটা উল্টা করে লেখা। আয়নার সামনে ধরলেই শুধু পড়া যায়।
এর মানে কি? আমি মিসির আলি স্যারকে জিজ্ঞেস করলাম, একজন মানুষের পক্ষে কি একই সময় দুটি ভিন্ন সত্তায় যাওয়া যায়?
স্যার বললেন যাওয়া যায়। মনে কর তুমি স্বপ্ন দেখছি। স্বপ্নে তুমি জেগে৷ তোমার মার সঙ্গে গল্প করছি। এখন তোমার দুটি সত্তা হয়ে গেল। একটিতে তুমি ঘুমোচ্ছ একটিতে তুমি জেগে আছ।
আমি বললাম, একজন জোয়ার্দার সত্যি আছেন, আরেকজনকে আমি স্বপ্নে দেখছি এ রকম কি হতে পারে?
স্যার বললেন, হতে পারে। চিরকুমার জোয়ার্দার হয়তো তোমার ব্রেনের সৃষ্টি। তার প্রতি তীব্র আবেগের কারণে ব্রেইন এই খেলাটা খেলাচ্ছে তবে কিন্তু আছে।
কি কিন্তু?
মিরর ইমেজগুলি কিন্তু। তুমি খবরের কাগজের মিরর ইমেজ এনেছ এর অর্থ তুমি স্বপ্নের জগৎ থেকে একটা কাগজ নিয়ে এসেছি। এটা কোনো ক্রমেই সম্ভব না। প্রকৃতি এ ধরনের কিছু ঘটতে দেবে না।
আমি বললাম, স্যার আমি কি এই বিষয়টা জোয়ার্দারের সঙ্গে আলাপ করব?
স্যার বললেন, করতে পাের। দুই জোয়ার্দারের সঙ্গেই আলাপ করবে। কে কি ভাবে নিচ্ছে তা দেখবে। তোমার সমস্যা সমাধানের জন্যে এদেয়। দুজনেরই সাহায্য লাগবে।
এর মধ্যে চিরকুমার জোয়ার্দার এক রাতে তার সঙ্গে খেতে বলল। সে নিজেই রাধবে। একা থাকার কারণে তার রান্নার হাত না-কি খুলেছে। সন্ধ্যা মিলাবার পর পর তার বাসায় গেলাম। বেল টিপতেই বাচা একটা মেয়ে দরজা খুলল। তার হাতে বিড়াল।
আমি বললাম, তোমার নাম অনিক?
অনিকা বলল, হ্যাঁ। আর এর নাম পুফি।
তোমার বাবা বাসায় নেই?
না। মাকে নিয়ে নিউমার্কেট কাচা বাজারে গেছেন। আমাদের চাল শেষ হয়ে গেছে। এই জন্যে। আমরা মিনিকেট চাল খাই। আপনি মিনিকেট চাল চেনেন?
না।
মিনিকেট চাল কি ভাবে বানানো হয় তা জানেন?
না।
মোটা চালকে মেশিনে কেটে চিকন বানানো হয়। একে বলে মিনিকাট। মিনিকাট থেকে এসেছে মিনিকেট।
বাহ্ তুমিতো অনেক কিছু জান।
কুকুর এবং বিড়ালের মধ্যে তফাৎ জানেন?
কিছুটা জানি। তুমি কি জান বল শুনি।
কুকুরকে যখন খাবার দেয়া হয় তখন কুকুর ভাবে মানুষ আমাদের দেবতা। এই জন্যে মানুষ আমাদের খাওয়াচ্ছে। আর বিড়ালকে যখন খাবার দেয়া হয় তখন বিড়াল ভাবে আমরা মানুষের দেবতা এই জন্যে মানুষ আমাদের যত্ন করছে!
সুন্দরতো। কার কাছে শুনেছ?
আমাদের মিসের কাছ থেকে। মিসের নাম শিরিন। আমরা তাকে ডাকি বি শিরিন।
বি শিরিন কেন?
উনি বাঁটকুতো এই জন্যে বি শিরিন। বাঁটকু শিরিন থেকে বি শিরিন।
মেয়েটার সঙ্গে কথা বলে আমার হৃদয় হাহাকারে পূর্ণ হল। এই চমৎকার মেয়েটাতো আমারো হতে পারত।
অনিকা বলল, আপনি কি বাবার জন্যে অপেক্ষা করবেন?
আমি বললাম, না। তোমার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করে চলে যাব।
চা খাবেন? আমি চা বানাতে পারি। বসার ঘরে বসুন, আমি চা বানিয়ে আনছি।
মেয়েটির বসার ঘরে বসলাম। এই ঘর আমি ছবিতে দেখেছি। দেয়ালে ক্যালেন্ডার ঝুলছে।
মোবাইল ফোনের ক্যামেরা অপসান দিয়ে ক্যালেন্ডারের ছবি তুললাম। ক্যালেন্ডারের লেখা ছবিতে উল্টা এল। মিরর ইমেজ। কি হচ্ছে এসব?
বাসায় ফিরে হুইস্কির বোতল খুলে বসলাম। পেগের পরে পেগ খাচ্ছি, নেশা হচ্ছে না।
রাত একটার দিকে আমার কাছে টেলিফোন এল। জোয়ার্দার টেলিফোন করেছে। সে বলল, আমি তোমার জন্যে রান্না করেছি। তুমি আসিনি কেন? কোন সমস্যা?