শায়লা বলল, ঠিক বলেছেন। আমার চোখে কেন পড়ল না?
তুমি ভাল করে তাকাওনি এই জন্যে চোখে পড়ে নি। এখন বরকতউল্লাহ সাহেবের একটা ছবি দেখাচ্ছি। এই দেখ। ছবিটিতে অতি অদ্ভুত একটা বিষয় আছে। এটা বের কর।
শায়লা বলল, স্যার আমি অদ্ভুত কিছু দেখতে পাচ্ছি না।
মিসির আলি বললেন, বরকতউল্লা সাহেবের তিনটি ছবি আমাকে দিয়ে গেছ। এই একটাতে বরকতউল্লা সাহেবের পেছনের দেয়াল খানিকটা ছবিতে এসেছে। দেয়ালে ক্যালেন্ডার ঝুলছে। ক্যালেন্ডারের একটা কোনা ছবিতে এসেছে। ক্যালেন্ডারের কোনার দুটা তারিখই এসেছে উল্টা। এর অর্থ বরকতউল্লাহ সাহেবের মিরর ইমেজ আছে। এই ছবিতে।
শায়লা বিস্মিত গলায় বলল, এর মানে কি?
মিসির আলি বললেন, আমিও তোমার মতই ভাবছি, এর মানে কি?
শায়লা বলল, আমাকে দুদিন সময় দিন আমি ঘটনা বের করে ফেলব।
মিসির আলি বললেন, গুড লাক।
তার গলার স্বরে তেমন ভরসা নেই।
শায়লা এজি অফিসে। দুপুর একটা লাঞ্চ বিরতি। শায়লা খোজ নিয়ে জানল, জোয়ার্দার আজ অফিসে আসেন নি। সিক লিভ নিয়েছেন। বরকতউল্লাহ অফিসে আছেন।
সরকারি অফিসে টিলাঢালা ভাব থাকে। হুট হাট করে যে কোনো ঘরে যে কেউ ঢুকে যেতে পারে।
বরকতউল্লার ঘরের সামনে টুল পেতে বেয়ারা বসে আছে। তাকে পাশ কাটিয়ে শায়লা ঢুকে পড়ল। বেয়ারা কিছু বলল না, উদাস চোখে তাকিয়ে রইল।
বরকতউল্লার সামনে হটপটে দুপুরের খাবার। তিনি এখনো খাওয়া শুরু করেন নি। শায়লা বলল, আমি অসময়ে চলে এসেছি। তার জন্যে লজ্জিত। আমি আপনার এক মিনিট সময় নেব।
বলুন কি ব্যাপার।
শায়লা ব্যাগ থেকে তিনটা ছবি বের করে বরকতউল্লার সামনে রাখতে রাখতে বলল, এই ছবিগুলি নিশ্চয়ই আপনার।
হ্যাঁ।
ছবিগুলি কে তুলেছে?
বরকতউল্লাহ একটা ছবি হাতে নিয়ে বলল, কে তুলেছে বলতে পারছি না।
কোথায় তোলা হয়েছে তা বলতে পারবেন?
না।
আপনি কি আপনার অফিসের কলিগ জোয়ার্দার সাহেবের বাসায় কখনো গিয়েছিলেন?
না তো।
আপনার কাছ থেকে এক মিনিট সময় নিয়েছিলাম। এক মিনিটের বেশি হয়ে গেছে। এখন আমি যাই?
বরকতউল্লাহ বললেন, আপনি বসুন। আপনার পরিচয় দিন। হুট করে এসে কয়েকটা ছবি দেখিয়ে চলে যাবেন তাতো হবে না। ছবিগুলি কে তুলেছে?
শায়লা বলল, আমি একজন ডাক্তার। ক্লিনিক্যাল সাইকিয়াট্রি হল আমার বিষয়। আমার একজন পেশেন্ট আমাকে এই ছবিগুলি দিয়েছেন। আমি বিষয়টা অনুসন্ধান করছি।
আপনার কথাতো আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
আমি নিজেও এখন কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি যাই।
শায়লা ঝড়ের বেগে ঘর থেকে বের হল। তার পেছনে পেছনে বরকতউল্লাহ বের হলেন। বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইলেন।
এজি অফিস থেকে জোয়ার্দারের বাসার ঠিকানা শায়লা নিয়েছে। ভর দুপুরে জোয়ার্দারের বাসায় উপস্থিত হওয়া কোন কাজের কথা না। শায়লা তাই করল।
অনেকক্ষণ বেল টেপার পর জোয়ার্দার নিজেই দরজা খুললেন, অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন শায়ালার দিকে।
শায়লা বলল, আপনি কি আমাকে চিনেছেন?
জোয়ার্দার বললেন, চিনব না কেন? তুমি আগের মতই আছ। শরীর সামান্য ভারি হয়েছে। আমার ঠিকানা কোথায় পেয়েছ।
আপনার অফিস থেকে ঠিকানা নিয়েছি।
আমি যে এজি অফিসে কাজ করি সেটা জান কি ভাবে?
শায়লা বলল, আমার শরীর খারাপ লাগছে, মাথা ঘুরছে। আমি কি আপনার বসার ঘরে কিছুক্ষণ বসতে পারি।
অবশ্যই পার। এসো।
আপনার স্ত্রী কিছু মনে করবেন নাতো?
জোয়ার্দার বললেন, শায়লা আমিতো বিয়েই করি নি। স্ত্রী আসবে কেত্থেকে?
শায়লা বিড়বিড় করে বলল, ও আচ্ছা আচ্ছা। আমি এক গ্রাস পানি খাব।
তুমি বস। আমি পানি আনছি। তোমাকে এ রকম বিধ্বস্ত লাগছে কেন? দুপুরে খেয়েছ?
না।
আমার সঙ্গে দুপুরে খেতে কোনো সমস্যা আছে?
না।
শায়লা বলল, আপনার মেয়ে অনিকা কোথায়?
জোয়ার্দার অবাক হয়ে বললেন, তোমাকে একটু আগে বলেছি। আমি বিয়ে করি নি। এখন হঠাৎ মেয়ে প্রসঙ্গ তুললে কেন? আমি একা বাস করি। একাও ঠিক না। আমার একটা পোষা বিড়াল আছে।
শায়লা বলল, বিড়ালের নাম কি পুফি?
হ্যাঁ পুফি! বিড়ালের নাম জানলে কি ভাবে।
শায়লা জবাব দিল না। চোখ মুখ শক্ত করে বসে রইল। জোয়ার্দার বললেন, কোনো সমস্যা?
শায়লা বলল, হ্যাঁ সমস্যা বিরাট সমস্যা। আমার মাথা দপ দপ করছে। মাথায় পানি ঢালতে হবে। আপনার বাথরুমটা কি ব্যবহার করতে পারি।
অবশ্যই পার। এসে বাথরুম দেখিয়ে দিচ্ছি।
ড. শায়লার ডায়েরি
ড. শায়লার ডায়েরি।
ডায়েরি ইংরেজীতে লেখা। এখানে বাংলা ভাষ্য দেয়া হল। শুরুর দুটি fir, I am lost. I am totaly lost.
আমি তলিয়ে গেছি। পুরোপুরি তলিয়ে গেছি। আমার ব্রেইনের নিউরো ট্রান্সমিটার সিগন্যাল পাঠানোয় ভুল করছে কিংবা তথ্য গুছাতে পারছে না। সব এলোমেলো করে দিচ্ছে।
শারিরীক ভাবেও আমি ভেঙে পড়েছি। শরীরে প্রচুর এলকোহল নেবার পরও আমার ঘুম আসছে না। আমার ক্ষুধা কমে গেছে। তবে তৃষ্ণ বেড়েছে। কিছুক্ষণ পরপরই মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে। তখন পানি খাচ্ছি তাতেও শুকনা ভাব দূর হচ্ছে না। এই সঙ্গে শুরু হয়েছে ভার্টিগো সমস্যা। সারাক্ষণ মনে হয়। চারপাশের সব কিছু ঘুরছে। চোখ বন্ধ করে রাখলেও এই ঘুর্ণন বন্ধ হয় না।
আমার জীবনের ঘটনা প্রবাহ ভালমত লিখে যাওয়া অত্যন্ত জরুরী। কারণ আমার জীবনের ঘটনাবলি ব্যাখ্যার দাবি রাখে। আমি নিজে ব্যাখ্যা করতে পারলে ভাল হত, তা পারছি না। বিশেষ বিশেষ সময়ে হাতীর পা কাদামাটিতে আটকে পড়ে মিসির আলি স্যারের পা এখন কাদাবন্দি। তিনি অবশ্যি পা টেনে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আমি হাল ছেড়ে দিয়েছি।