জোয়ার্দার অনেকক্ষণ হল বসার ঘরে বসে আছেন। সুলতানা আসছে। না। এগারোটা বেজে গেছে এখন ঘুমুতে যাওয়া উচিত। তবে কাল ছুটির দিন কাজেই আজ একটু দেরীতে ঘুমুতে গেলেও ক্ষতি হবে না।
টিভি দেখতে দেখতে জোয়ার্দার ঘুমিয়ে পড়লেন।
রঞ্জু কেবিনে শুয়ে কাতড়াচ্ছে। বিড়াল তার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় কামড়েছে। সেলাই লেগেছে নয়টা। ডাক্তার তাকে সিডেটিভ ইনজেকশান দিয়েছেন।
সুলতানা হাসপাতালে পৌছে দেখেন রঞ্জু ঘুমাচ্ছে। ঘুমের মধ্যেই কেঁপে কেঁপে উঠছে। হাত দিয়ে অদৃশ্য কিছু তাড়াবার চেষ্টা করছে।
টেলিফোনে ক্রমাগত ক্লিং হচ্ছে। জোয়ার্দারের ঘুম ভাঙ্গল রিং এর শব্দে।
হ্যালো কে?
আমি শায়ালা।
ও আচ্ছা।
জোয়ার্দার টিভির উপর রাখা ঘড়ির দিকে তাকালেন। রাত একটা দশ।
এতবার টেলিফোন করলাম টেলিফোন ধরছে না। প্রথমে তোমার মোবাইলে করেছি না পেয়ে শেষে ল্যান্ডফোনে।
জোয়ার্দার বললেন, আপনি কি প্রচুর এলকোহল খেয়েছেন।
শায়লা বলল, হ্যাঁ খেয়েছি। আমি পুরোপুরি ড্রাঙ্ক। সোজা বাংলায় মাতাল। মাতাল বলেই তুমি তুমি করছি।
শায়ালা কোনো সমস্যা?
হ্যাঁ সমস্যা। তোমার কারণে একজন আজ আমাকে চূড়ান্ত অপমান করেছে।
কে অপমান করেছে? সুলতানা?
না। মিসির আলি সাহেব। আপনার তোলা বরকতউল্লার ছবি নিয়ে গিয়েছিলাম। ছবিগুলি দেখতে বললাম। উনি দেখলেন না। বরং এমন কথা বললেন যেন আমি একজন মানসিক রুগী।
মিসির আলি সাহেব কে?
আছেন। একজন আপনি না চিনলেও চলবে।
শায়লা কাঁদছ কেন?
মাতাল হয়েছি। এই জন্যে কাঁদছি। আপনিতো মাতাল হননি। আপনি কেন আমাকে তুমি তুমি করছেন?
সরি।
আপনি আর কখনো আমার অফিসে আসবেন না।
আচ্ছা আর যাব না।
শায়লা টেলিফোন রেখে দিল।
রান্নাঘরে চায়ের কাপে
রান্নাঘরে চায়ের কাপে চামচ নাড়ার শব্দ হচ্ছে। বসার ঘরে অস্বস্থি নিয়ে বসে আছে শায়লা। সে ছবিগুলি নিতে এসেছে। তার ধারণা মিসির আলি ছবি দেখেন নি। এক সপ্তাহ পার হয়েছে এখনো ছবি না দেখা হয়ে থাকলে আর দেখা হবে না।
রান্নাঘর থেকে মিসির আলি বললেন, শায়লা তুমি চায়ে ক চামচ চিনি খাও।
দু চামচ।
মিসির আলি বললেন, ঘরে টেস্ট বিসকিট আছে। চায়ের সঙ্গে খাবে?
না স্যার।
মিসির আলি ট্রেতে দুকাপ চা এবং পিরিচে। কয়েকটা টেস্ট বিসকিট নিয়ে ঢুকলেন। শায়লার সামনে ট্রে রাখতে রাখতে বললেন, একটা টেস্ট বিসকিট খেয়ে দেখো ভাল লাগবে। টেস্ট বিসকিটের গায়ে পনির দেয়া আছে। পনিরের উপর এক ফোঁটা রসুনের রস। গাৰ্লিক টোস্ট উইথ চিজ। রান্নার বই এ পেয়েছি।
আপনি রান্নার বই পড়েন?
কেন পড়ব না? আমি রাঁধতে পারি না। কিন্তু রান্নার বই পড়তে ভালবাসি। তুমি কি জান সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়া পার্ল এস বাকের চায়নীজ রান্নার উপর একটা বই আছে; আমি অনেক খোজ করছি কিন্তু বইটা পাচ্ছি না।
আপনার গার্লিক টোস্ট উইথ চীজ খুব ভাল হয়েছে।
মিসির আলি চায়ে চুমুক দিলেন। তিনি কৌতূহলী চোখে তাকাচ্ছেন।
শায়লা বাড়তি কৌতূহলের কারণ ধরতে পারছে না।
স্যার আপনি কি ছবিগুলি দেখার সময় পেয়েছিলেন?
মিসির আলি বললেন, তুমি যে দিন ছবিগুলি দিয়ে গেলে তার পর দিন ভোরবেলায় দেখেছি। এজি অফিসের সঙ্গে দুপুরবেলা যোগাযোগ করেছি। সেখান থেকে জানলাম বরকতউল্লাহ সাহেব জীবিত! প্রমোশন পেয়ে তিনি ডিএজি হয়েছেন।
শায়লা চায়ে চুমুক দিয়েছিল, মিসির আলির কথায় বিষম খেল। নিজেকে সামলে নিয়ে বিড়বিড় করে বলল, Oh God.
তোমার নিজের কি ধারণা জোয়ার্দার সাহেব কেন একজন জীবিত মানুষকে মৃত ঘোষণা করলেন?
স্যার আমার ধারণা তিনি আমার সঙ্গে দেখা করার অজুহাত হিসেবে এইসব গল্প করেন। উনার সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল। কথাবার্তা অনেকদূর এগোনোর পর বিয়ে ভেঙে যায়। আমার প্রতি উনার আলাদা দুর্বলতা একটা কারণ হতে পারে।
তোমার কি ঐ ভদ্রলোকের প্রতি কোনো দুর্বলতা আছে?
না।
বিয়ে করেছ?
জ্বি-না।
বাড়িতে একা থাক?
জ্বি। আমি আর একটা কাজের মেয়ে।
জোয়ার্দার কি জানে তুমি নিঃসঙ্গ জীবন যাপন কর?
জানেন না। আমি তাকে বলেছি যে একটি মেয়েকে আমি পালক নিয়েছি। ওর সঙ্গে দুষ্টামী করে আমার সময় কাটে।
মিথ্যা কথা কেন বলেছ?
যাতে সে কোনো রং সিগনাল না পায়; ভেবে না বসে তার সঙ্গে বিয়ে না হওয়ায় আমি মেয়ে দেবদাস হয়ে গেছি।
মিসির আলি বললেন, তাইতো হয়েছ। তুমি যখন হাইলি ইনটকসিকেটেড অবস্থায় থাক তখন কি জোয়ার্দারের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ কর?
দুবার করেছি।
জোয়ার্দারের তোমার প্রতি কি মনোভাব তা আমি জানি না। তবে তুমি যে মহিলা দেবদাস তা আমি যেমন জানি তুমিও জান। রোগীর সমস্যা নিয়ে ছুটে এসেছ আমার কাছে।
শায়লা উঠে দাঁড়াল। আহত গলায় বলল, স্যার আমি যাব। চেম্বারের সময় হয়ে গেছে। ছবিগুলি দিন।
মিসির আলি বললেন, বসো। ছবি নিয়ে তোমার সঙ্গে জরুরী কথা আছে। ছবিগুলি অত্যন্ত বিস্ময়কার!
বিস্ময়কর কোন অর্থে?
মিসির আলি বললেন, সব অর্থেই। তুমি বস আমি বলছি।
তিনি পড়ার টেবিলে ড্রয়ারে রাখা ছবিগুলি নিয়ে এলেন। অনিকার কোলের বিড়াল এবং আলাদা বিড়ালের ছবি শায়লার সামনে রাখতে রাখতে বললেন, বিড়াল দুটার মধ্যে তুমি কি কোনো পার্থক্য দেখছ?
শায়লা বলল, জ্বি না। দুটা একই বিড়াল।
মিসির আলি বললেন, একই বিড়াল না। একটার ডান চোখের উপর সাদা স্পট, অন্যটার বাঁ চোখের উপর শাদা স্পট। বিড়াল দুটার একে অন্যের মিরর ইমেজ। বাচ্চা মেয়েটার কোলের বিড়াল আয়নার সামনে যে বিড়াল দেখা যাবে অন্যটা সেই বিড়াল।