বিড়ালের মনে হয় কথা শুনতে ভালো লাগছিল না। সে জোয়ার্দারের টেবিলের নিচে ঢুকে তার চোখের আড়াল হয়ে গেল। জোয়ার্দার অবশ্যি কথা বন্ধ করলেন না। চালিয়ে যেতে থাকলেন। তিনি বললেন, বেশি বুদ্ধি থাকা কোনো কাজের কথা না। এ জন্য বাংলা ভাষায় বাগধারা আছে অতি চালাকের গলায় দাঁড়ি। আমার শ্যালক রঙ্গুর অসম্ভব বুদ্ধি। অর্থাৎ অতিচালক। এ কারণেই তার গলায় দড়ি পড়েছে। বিরাট ঝামেলায় আছে। কী ঝামেলা সেটা আমার কাছে পরিষ্কার না। আমার স্ত্রী তাকে নিষেধ করে দিয়েছে সে যেন বাসায় কখনো না আসে।
এই কুফি একটু বের হ! তোর ছবি তুলব। শায়লা তোর ছবি দেখতে চাচ্ছে। তোর কথা শায়লাকে বলেছি। সে বিশ্বাস করে না। ছবি দেখলে বিশ্বাস করবে।
কুফি আড়াল থেকে বের হলো। জোয়ার্দার তার বেশ কিছু ছবি তুললেন। সে আপত্তি করল না। জোয়ার্দার বললেন, বাড়িতে বিরাট ঝামেলা হচ্ছে। অফিসে আমি আরামে আছি।
কুফি বলল, মিয়াঁও।
বাড়ির ঝামেলাটা কি তা জানার কোনো আগ্রহ জোয়ার্দার বোধ করছেন না। সুলতানা তাকে জানাতে চাইছে না। কী দরকার জানার চেষ্টা করা?
ঝামেলাটা ঘটায় সুলতানার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কিছু উন্নতি হয়েছে। সুলতানা আগের মতো কথায় কথায় চেঁচিয়ে উঠছে না। এটা অনেক বড় ব্যাপার।
কাজের মেয়ে দুটো এখন বাসায় থাকছে না। অনিকার কাছে শুনেছেন তারা রঞ্জুর কাছে আছে। সুলতানা নতুন বুয়া রেখেছেন। তার নাম সালমা। দেখতে রাঙ্গুসীর মতো। তবে মেয়েটা কাজের। জোয়ার্দারের কখন কী লাগবে বুঝে গেছে। আগের দুজন সাজগোজ নিয়েই থাকত। সালমা সাজগোজের কী করবে? রাঙ্গুসীকে সাজতে হয় না।
কী ভাবছেন?
জোয়ার্দার চমকে উঠলেন। তাঁর টেবিলের পাশে আধশোয়া হয়ে বিশ্রাম নেবার জন্য একটা বেতের ইজিচেয়ার আছে। সেখানে বরকতউল্লাহ বসে আছেন। বিড়ালটা এখন বসেছে চেয়ারের নিচে। দুজনই তাকিয়ে আছে জোয়ার্দারে দিকে।
বরকতউল্লাহ বললেন, এসির টেম্পরেচার এত কম রেখেছেন! ঘরটা তো ডিপ ফ্রিজ হয়ে গেছে।
টেম্পারেচার কি বাড়িয়ে দেব?
না, থাক।
জোয়ার্দার বললেন, আপনার ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছি না।
বরকতউল্লাহ বললেন, কোন ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন না?
আপনি কোথেকে আসেন। কিভাবে আসেন।
এটা না বোঝার কী আছে?
আপনি যে মারা গেছেন এটা জানেন?
বরকতউল্লাহ বললেন, আপনার সমস্যা কি? উল্টা পাল্টা কথা বলছেন কেন?
জোয়ার্দার লজ্জিত গলায় বললেন, কিছু কি খাবেন? চা বা কফি।
না।
জোয়ার্দার বললেন, আমার ধারণা আমার মাথায় কোনো ঝামেলা হয়েছে।
বরকতউল্লাহ বললেন, হতে পারে। ভালো ডাক্তার দেখান। সাইকিয়াট্রিস্ট।
জোয়ার্দার বড় করে নিঃশ্বাস ফেললেন।
বরকতউল্লাহ বললেন, দেরি করবেন না। প্রথম অবস্থায় রোগ ধরা পড়লে দ্রুত চিকিৎসা করে কন্ট্রোল করা যায়। আমার ছোট বোন নাইমা ব্রেস্টট ক্যানসারে মারা গেল। শুরুতে ধরা পড়লে ব্রেস্ট ক্যানসার কোনো ব্যাপারই না। তিনটা ছোট ছোট বাচা নিয়ে তার স্বামী কী বিপদেই না পড়েছে।
বরকতউল্লাহ উঠে দাঁড়ালেন। হাই তুলতে তুলতে বললেন, আচ্ছা যাই। কাজ করছিলেন, কাজের মধ্যে ডিসটর্ব করলাম।
বরকতউল্লাহ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে দরজা দিয়ে বের হয়ে গেলেন। বিড়ালটাও পিছু পিছু গেল। কেউই হাওয়ায় মিলিয়ে গেল না।
আমি অপেক্ষা করব
তিনি ওয়েটিং রুমে বসে আছেন। তার সিরিয়াল এসেছে নয়। শায়লার এসিসটেন্ট করিম গলা নামিয়ে বলল, আপনার সিরিয়ালে ব্রেক করতে পারি। অন্যরা রাগ করবে। এইটাই সমস্যা।
জোয়ার্দার বললেন, আমি অপেক্ষা করব।
করিম বলল, একটা কাজ করি স্যার? সব রুগী বিদায় হবার পর আপনি যান। কথা বলার সময় বেশি পাবেন।
আমি যে সিরিয়াল পেয়েছি সেই সিরিয়ালেই যাব।
আজও মিষ্টি এনেছেন?
হুঁ।
ম্যাডাম কিন্তু মিষ্টি খান না।
তার মেয়েটা খাবে।
ম্যাডাম শাদী করেন নাই। মেয়ে কোথায় পাবেন।
উনার একটা পালক মেয়ে আছে সুপ্তি নাম। সুপ্তি খাবে।
কি যে কথা বলেন। উনার পালক মেয়ে টেয়ে কিছু নাই। একজন বুয়া আছে।
ও আচ্ছা।
নয়। নম্বার তার ডাক পড়ল না। অন্য রুগীরা যেতে থাকল। করিম গলা নামিয়ে বলল, আপনি এসেছেন ম্যাডামকে বলেছি। উনি বলেছেন। আপনাকে সবার শেষে পাঠাতে।
আচ্ছা ঠিক আছে।
আমার কথাই ঠিক হয়েছে। তাই না। স্যার?
হুঁ।
চা-কফি কিছু খাবেন?
না।
জোয়ার্দার আগ্রহ নিয়ে ওয়েটিং রুমের লোকজন দেখছেন। রুণী হিসেবে তিনি শুধু একা এসেছেন, অন্য সবার সঙ্গে দুতিনজন করে এসিসটেন্ট। ষোল সতেরো বছরের একটি তরুণী মেয়ে এসেছে মনে হচ্ছে সেই রুগী। দুহাতে মুখ ঢেকে রেখেছে। সে তাঙ্কাচ্ছে আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে। মধ্য বয়স্ক যে ভদ্ৰলোক মেয়েটাকে নিয়ে এসেছেন। তিনি কিছুক্ষণ পর পর মেয়েটার হাত নামিয়ে দিচ্ছেন তাতে লাভ হচ্ছে না। মেয়েটা সঙ্গে সঙ্গে দুহাতে মুখ ঢাকছে।
জোয়ার্দারের ডাক পড়েছে। তিনি ঘরে ঢুকতেই শায়লা বলল, রসমালাই আনেন নি?
জোয়ার্দার বললেন, এনেছি। আপনার এসিসটেন্টের কাছে দিয়েছি।
ভেরি গুড।
আপনার ক্যামেরাটাও নিয়ে এসেছি।
ছবি তুলেছেন?
জ্বি।
ছবি উঠেছে?
জ্বি উঠেছে।
শায়লা বিস্মিত হয়ে বললেন, দেখি ছবি?
জোয়ার্দার ছবি দেখাচ্ছেন। শায়লা তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। আশ্চর্যের ব্যাপার, সত্যি এক ভদ্রলোকের ছবি।
জোয়ার্দার বললেন, এটা বরকতউল্লাহ সাহেবের ছবি। উনি টিভি দেখছেন। উনার তিনটা ছবি তুলেছি। সব ছবি ডান দিক থেকে তুলতে হয়েছে। উনার মাথার বাঁ দিকে চুল কম। এই জন্যে।