- বইয়ের নামঃ পুফি
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- সিরিজ বইঃ মিসির আলী
- প্রকাশনাঃ অনন্যা
- বিভাগসমূহঃ ভূতের গল্প, উপন্যাস, রহস্যময় গল্প, রোমাঞ্চকর গল্প
আবুল কাশেম জোয়ার্দার
উৎসর্গ
নিষাদ তার নানাজানিকে ডাকে মহারাজ। মহারাজ বিড়াল দুচক্ষে দেখতে পারেন না। তার ফ্ল্যাটে পুফি নামে একটা বিড়াল ছিল তাকে তিনি অঞ্চল ছাড়া করেছেন। লাভ হয়নি, অদ্ভুত অদ্ভুত সময়ে বিড়াল তাঁর ঘরে ঢুকে। কেমন করে জানি তাকিয়ে থাকে।
বিড়াল বিদ্বেষী মহারাজা ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আলী
শ্ৰদ্ধাভাজনেষু
ভূমিকা
শুরুতেই সাবধানবাণী, এটি কোনো শিশুতোষ বই না। পুফি নামের কারণে অভিভাবকরা অবশ্যই বিভ্ৰান্ত হয়ে তাদের ছেলেমেয়েদের এই বই কিনে দেবেন না। পুফিতে এমন সব বিষয়ের অবতারনা করেছি যা থেকে শিশু কিশোরদের একশ হাত দূরে থাকা প্রয়োজন।
ব্যাখ্যার অতীত জগৎ আমার অতি প্রিয় বিষয়। পুফিকে নিয়ে ব্যাখ্যার অতীত গল্পই লিখতে চেষ্টা করেছি। আমার নিজের মাঝে মাঝে মনে হয়। আমরা যে জগতে বাস করছি সেটাইতো ব্যাখ্যার অতীত। বাইরে থেকে পুফি আনার প্রয়োজন কি? কথাটা ভুল না।
হুমায়ূন আহমেদ
দখিন হাওয়া।
০১.
আবুল কাশেম জোয়ার্দার কোনো পশু-পাখি পছন্দ করেন না। ছোটবেলায় তাঁর বয়স যখন তিন, তখন এক ছাদে বসে পাউরুটি খাচ্ছিলেন। কথা নাইবার্তা নাই দুটো দাঁড়কাক তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। একটা বসল। তার মাথায়, অন্যটা পাউরুটি নিয়ে উড়ে গেল। কাক শিশুদের ভয় পায় না। জোয়ার্দার চিৎকার করে অজ্ঞান হওয়ার আগ পর্যন্ত দাড়কাকটা গম্ভীর ভঙ্গিতে মাথায় বসেই রইল। দুটা ঠোকর দিয়ে মাথা জখম করে দিলো। পাখি অপছন্দ করার জোয়ার্দার সাহেবের এটিই হলো শানে নজুল।
পশু অপছন্দ করার পেছনে কুচকুচে কালো রঙের একটা পাগলা কুকুরের ভূমিকা আছে। জোয়ার্দার তখন ক্লাস ফোরে পড়েন। স্কুল ছুটি হয়েছে, সবাই বাড়ি ফিরছে, হঠাৎ পাগলা কুকুরটা ছুটে এসে তাকে কামড়ে ধরল। সব ছাত্র দৌড়ে পালাল, শুধু একজন তাকে রক্ষা করার জন্য ছুটে এল। তার নাম জামাল, সে পড়ে ক্লাস ফাইভে। জামাল তার বই নিয়ে কুকুরের মাথায় বাড়ি দিতে লাগল। কুকুরটা তাকেও কামড়াল। জোয়ার্দার সাহেবের বাবা ছেলের নাভিতে সাতটা ইনজেকশন দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন।
জামালের কৃষক বাবার সেই সমৰ্থ্য ছিল না। তিনি ছেলের জন্য চাল পড়ার ব্যবস্থা করলেন। নবীনগরের পীর সাহেবের পানি পড়া খাওয়ালেন। পাগলা কুকুরের কিছু লোম তাবিজে ভরে জামালের গলায় বুলিয়ে দেওয়া হলো। চাল পড়া, পানি পড়া এবং তাবিজে কাজ হলো না। জামাল মারা গোল জলাতঙ্কে। শেষ পর্যায়ে তাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছিল। সে কুকুরের মতোই ঘড়ঘড় শব্দ করতে করতে মুখ দিয়ে ফেনা তুলতে তুলতে মারা গেল।
জামালের মৃত্যুতে জোয়ার্দার সাহেবের মানসিক কিছু সমস্যা মনে হয় হয়েছে। বাড়িতে যখন কেউ থাকে না, তখন তিনি জামালকে চোখের সামনে দেখতে পান। জামাল স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ঘুরে বেড়ায়, অনিকার খেলনা নিয়ে খেলে।
জোয়ার্দার সাহেবের বয়স বেড়েছে, জামালের বাড়েনি। মৃত্যু আশ্চর্য ব্যাপার। মানুষের বয়স আটকে দেয়।
অনিকা জোয়ার্দার সাহেবের একমাত্র মেয়ে। সে এবার ফাইভে উঠেছে। পড়াশোনায় সে অত্যন্ত ভালো। সে যে ইংরেজি স্কুলে পড়ে, তার প্রিন্সিপাল জোয়ার্দার সাহেবকে ব্যক্তিগত চিঠি পাঠিয়েছেন। চিঠিতে লেখা We are proud to have your daught in our school…
জোয়ার্দার তার মেয়েকে অসম্ভব ভালোবাসেন। ভালবাসা প্ৰকাশ করতে পারে না। লজ্জা লজ্জা লাগে। জোয়ার্দার তা সঙ্গে গল্প করতে খানিকটা অস্বস্তি বোধ করেন। অস্বস্তি বোধ করার সংগত কারণ আছে। মেয়ের কোনো প্রশ্নের জবাবই তিনি দিতে পারেন না। ছুটির দিনগুলো জোয়ার্দার সাহেবের দুঃশ্চিন্তায় কাটে। এই তা মেয়ে তাঁর সঙ্গে ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ এবং ডিনার করে। অনিল তখন প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতে থাকে। তিনি শুকনো মুখ করে বসে থাকেন। মাঝেমধ্যে স্ত্রীর দিকে তাকান। তাঁর স্ত্রী সুলতানা মেয়েকে ধমক দেন, খাওয়ার সময় এত কথা কিসের?
ধমকে কাজ হয় না। অনিকার ধারাবাহিক প্রশ্ন চলতেই থাকে। কিছু প্রশ্নের নমুনা।
বিদ্যুৎ চমকের সময় কী হয়, জান বাবা?
না তো।
ইলেক্টিক্যাল এনার্জি তিন ভাগে ভাগ হয়ে যায় লাইট এনার্জি, সাউন্ড এবং হিট এনার্জি।
ভালো তো।
রিইনফোর্সড কংক্রিট করে বলে, জানো?
না।
সব বড় বড় বিল্ডিং রিইনফোর্স কংক্রিটে বানানো।
ও, আচ্ছা।
কংক্রিট কী জানো?
হুঁ।
বল তো কী?
ভাত খাওয়ার সময় এত কথা বলা ঠিক না।
ঠিক না কেন?
এতে হজমের সমস্যা হয়।
খাবার হজম করার জন্য আমাদের পাকস্থলীতে দুরকমের এসিড বের হয়। এদের নাম বলতে পারবে?
জোয়ার্দার সাহেবকে হতাশ গলায় বলতে হয়, না।
অনিকার ছনম্বর জন্মদিনে জোয়ার্দার ধাক্কার মতো খেলেন। তাঁর মেয়ে একটা বিড়ালের বাচ্চা কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বিড়ালের বাচ্চা কুচকুচে কালো। শুধু লেজটা শাদা। বিড়ালের মাথায় শাদা স্পট আছে!
বিড়াল কোলে অনিককে দেখে মনে হচ্ছে, এ মুহূর্তে তার মতো সুখী বালিকা কেউ নেই। সে বিড়ালের গালের সঙ্গে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাঝে মাঝে বিড়ালের মতো মিউ মিউ করছে।
বাবা, এর নাম পুফি। আমি জন্মদিনে গিফট পেয়েছি; বল তো বাবা, কে দিয়েছে?