রাত দশটার সময় লাইলী রুবীনাকে ভাত খাওয়ার জন্য ডাকতে এসে দরজা বন্ধ দেখে কড়া নাড়া দিয়ে বলল, ভাত খাবে এস।
রুবীনার তখন এ্যাবনরমাল অবস্থা। সে ভাবির গলা শুনে অনেক কষ্টে গলার স্বর সংযত রেখে দরজা না খুলে বলল, তোমরা খেয়ে নাও, আমার শরীর খারাপ। আজ আমি কিছু খাব না।
লাইলী ফিরে এসে সেলিমকে রুবীনার কথা বললে সেলিম বলল, আজ ওর শরীর ও মন খুব খারাপ হওয়ার কথা, তার জন্য কোনো চিন্তা করো না।
ওদিকে রুবীনা যখন বুঝল, ভাবি ফিরে গেছে তখন সে ধীরে ধীরে আলমারীর কাছে গিয়ে ঘুমের ট্যাবলেটের শিশি হাতে নিল। প্রেগন্যান্ট হওয়ার পর থেকে সে রাত্রে একদম ঘুমাতে পারত না। তাই ঘুমের ট্যাবলেট এক শিশি কিনে ছিল। তাতে এখনো অনেক ট্যাবলেট আছে। রুবীনা সব ট্যাবলেট এক সঙ্গে খেয়ে ঘুমিয়ে গেল। সে ঘুম তার আর ভাঙ্গল না।
পরের দিন অনেক বেলা পর্যন্ত যখন রুবীনা ঘর থেকে বের হল না তখন লাইলী এসে দরজা ভেতর থেকে বন্ধ দেখে কড়া নাড়া দিয়ে ডাকতে লাগল। কোনো সাড়া না পেয়ে লাইলীর মনে সন্দেহ হল। সে কাচের জানলা দিয়ে দেখার চেষ্টা করল। কিন্তু জানালাও ভিতর থেকে বন্ধ। পর্দা ঝুলছে। শেষে ফিরে গিয়ে শাশুড়ীকে ও স্বামীকে জানাল।
আরিফও সেখানে ছিল। সবাই মিলে তাড়াতাড়ি করে এসে দরজা জানালা কিছুই খুলতে পারল না। অনেক ডাকাডাকি করেও কোনো সাড়া পেল না। শেষে আরিফ জানালার কাচ ভেঙ্গে পর্দা সরিয়ে দেখল, রুবীনা খাটের উপর শুয়ে আছে। সেলিম ও আরিফ খুব জোরে ডাকতে লাগল। কিন্তু রুবীনার কাছ থেকে কোনো সাড়া এল না। তখন লাইলীর সন্দেহ দৃঢ় হল। স্বামীকে বলল, তুমি শীগগীর একটা মিস্ত্রী নিয়ে এসে দরজা খোলার ব্যবস্থা কর, নচেৎ দরজা ভেঙ্গে ফেল।
কথাটা আরিফ শুনতে পেয়ে ছুটে বাজারের মোড় থেকে দুজন কাঠের মিস্ত্রী ডেকে নিয়ে এলে তারা দরজা ভেঙ্গে দিল। ভিতরে ঢুকে রুবীনাকে মৃত দেখে সবাই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। কিছুক্ষণ পর লাইলী একটা চাদর দিয়ে রুবীনাকে ঢাকা দিয়ে দিল। সেলিম থানায় ফোন করল। লাইলী শাশুড়ীকে বৃথা প্রবোধ দিতে লাগল। সেলিম টেবিলের উপর ভাঁজ করা কাগজ দেখতে পেয়ে হাতে নিয়ে পড়ে সবাইকে শুনাল। আরিফ হাউ মাউ করে কাঁদতে কাঁদতে মা ও ভাইকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠল, রুবীনা, এ কি করল? আমরা তো কিছুই বুঝতে পারিনি। আমাদের যে আর কোনো বোন রইল না মা। রুবীনা, তুই যে আমাদের বড় আদরের বোন ছিলি, আমাদেরকে ফাঁকি দিয়ে চলে যেতে পারলি? যত বড় অন্যায় করে থাকিস না কেন, আমরা তোকে ক্ষমা করে দিতাম।
কিছুক্ষণ পরে দুজন সিপাই সঙ্গে করে দারোগা সাহেব এলেন। সেলিমের সঙ্গে তার আগে থেকে জানাশোনা। তার বড় ছেলে সেলিমদের মিলের অফিসে চাকরি করে। তিনি রুবীনার দুটি চিঠিই পড়লেন। তারপর তাদেরকে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করে ডাইরীতে তাদের মুখজবানী লিখে লাশ দাফন করার হুকুম দিয়ে ফিরে গেলেন।
রুবীনার মৃত্যুর পরে সারা বাড়িতে দুঃখের ছায়া নেমে এল। কারো মুখে হাসি নেই।
রুবীনার মৃত্যুর খবর পেয়ে জাহিদ সাহেবদের বাড়ির সবাই এসেছিল।
আসমা সোহানা বেগমকে জড়িয়ে ধরে অনেক কেঁদেছে। ফিরে যাওয়ার সময় সোহানা বেগমকে বলল, আমাকে তো মেয়ের মত মানুষ করেছেন; আমি আপনার পেটে না হয়েও যা স্নেহ ভালোবাসা, পেয়েছি তাতে করে নিজের গর্ভধারিণী মায়ের চেয়েও আপনাকে আমি বেশি জানি।
সোহানা বেগম রুবীনার এই পরিণামের জন্য নিজেকে দায়ী মনে করে আহার নিদ্রা ত্যাগ করে কেঁদে কেঁদে দিন কাটাতে লাগলেন। সেলিম ও আরিফ ব্যবসা বাণিজ্য দেখাশোনা করছে বটে, কিন্তু কারও মনে শান্তি নেই।
লাইলী একদিন বিকেলে চায়ের টেবিলে শাশুড়ীকে জোর করে নিয়ে এল। এতদিন তিনি নিজের ঘর থেকে বার হননি। সবাইকে চা দিয়ে লাইলী বলল, আজ আমি দু’একটা কথা না বলে থাকতে পারছি না।
আরিফ বলল, বেশ তো ভাবি! কি বলবে বল না।
লাইলী কয়েক সেকেণ্ড সবাইকে দেখল, তারপর বলল, আমরা আল্লাহকে সৃষ্টিকর্তা বলে বিশ্বাস করি কিনা? এবং তিনিই যে একমাত্র বিশ্বনিয়ন্তা, এ কথাও বিশ্বাস করি কি না?
সকলে লাইলীর দিকে চেয়ে রইল; কিন্তু কেউ কোনো উত্তর দিল না। লাইলী বলল, কি হল? তোমরা উত্তর দিচ্ছ না কেন? সেলিম বলল, মুসলমান মাত্রেই ঐ কথা সবাই বিশ্বাস করে। লাইলী বলল, আমরা এও বিশ্বাস করি, তার হুকুম ছাড়া কোনো কিছু হয়। সেইজন্য তার কোনো কাজে আমাদের অসন্তুষ্ট হওয়া উচিত না। দুঃখ কষ্টে, বিপদ-আপদে তিনি আমাদের সবর করতে বলেছেন। আমরা যদি তার কোনো কাজে অসন্তুষ্ট হই, তা হলে কি তাঁকে বিশ্বনিয়ন্তা বলে অস্বীকার করা হল
কি? সুখ দুঃখ মানুষের জীবনে দিন রাত্রির মত জড়িত। যে লোক সুখ দুঃখ দুটোই লোগ না করেছে, তার জীবন পূর্ণ হয় না। আর এ রকম লোক দুনিয়াতে আছে কি না সন্দেহ। এই দুর্ঘটনায় আমরা খুব দুঃখ পেয়েছি। আল্লাহর কাছে আমরা তা সইবার ক্ষমতা চাইব। তারপর লাইলী শাশুড়ীকে জড়িয়ে ধরে বলল, মা, এক রুবীনাকে আল্লাহ নিয়েছেন তো কি হয়েছে? এ দুনিয়াতে রুবীনার মত কত শত মেয়ে আছে, তারাও যেন রুবীনার মত দুর্ঘটনায় না পড়ে, সেজন্য আমাদের সবাইকে সচেষ্ট থাকতে হবে। যদি আমরা তা করি, তা হলে নিশ্চয় আল্লাহ খুশি হবেন। তখন সোহানা বেগমের চোখ দিয়ে পানি পড়ছিল। লাইলী নিজের আঁচল দিয়ে মুছে দিয়ে বলল, আমাকে রুবীনা মনে করে দীলে তসল্লি দিন মা। দোয়া করুন, আমি যেন রুবীনার মতো হয়ে আপনার দুঃখ ভুলাতে পারি।