সেলিম বলল, আমি তোমার কথায় কখনো মাইড করেছি?
লাইলী বলল, রুবীনা মনিরুলের সঙ্গে প্রতিদিন বেড়াতে যায়। ফিরে আসে রাত করে। ও এখন বড় হয়েছে। অত রাতে বাড়ি ফেরা আমি ভালো মনে করি না।
সেলিম বলল, তুমি ঠিক বলেছ। আমিও মাঝে মাঝে তা লক্ষ্য করেছি। তোমাকে তো সেদিন আসমা আর মনিরুলের ব্যাপারটা বলেছি। এক কাজ কর, আজ আমরা সবাই আমাকে দেখতে যাই চল। সে আজ কেন এল না? নিশ্চয়ই কোনো অসুখ বিসুখ হয়েছে। রেহানা এসেছে কি?
লাইলী বলল, হ্যাঁ সে মায়ের সঙ্গে কথা বলছে। সেলিম বলল, তুমি রেহানা, মনিরুল ও রুবীনাকে কথাটা বলে এসে তৈরি হয়ে নাও। আমরা এক্ষুণি বেরুব।
দুটো গাড়িতে করে সকলে এসে কনভেন্ট স্কুলের গেটের কাছে নামল। স্কুলের ফাংশান অনেক আগে শেষ হয়ে গেছে। আসমাকে ফাংশানে অনেক খাটাখাটনি করতে হয়েছে। তাই ক্লান্ত হয়ে ষ্টোভে চা করে ছেলেকে নিয়ে খাচ্ছিল।
সেলিম আসমার রুম চেনে। সবাইকে নিয়ে এগোল।
তাদেরকে দেখতে পেয়ে আসমা সালাম দিয়ে লাইলীকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমার কি সৌভাগ্য, তোমরা এই হতভাগীর কাছে এসেছ? সে মনিরুলকে লক্ষ্য করেনি।
সেলিম বলল, আজ বাড়িতে এলি না, ভাবলুম তোর কোনো অসুখ বিসুখ হল কিনা। তাই দেখতে এলুম।
আসমা বলল, আজ স্কুলে একটা ফাংশান ছিল। তাই যেতে পারিনি। ভাবছিলাম, এক্ষুণি সেকথা ফোনে তোমাদের জানাব। তোমরা এসে খুব ভালো হয়েছে। কিন্তু এত লোককে কোথায় বসতে দেব? লাইলীর দিকে চেয়ে বলল, তুমি বল না ভাবি, আমি এখন কি করব?
লাইলী আসমার ছেলেকে কোলে নিয়ে আদর করতে করতে বলল, তোমাকে কিছু করতে হবে না, ঘরে চাবি দিয়ে তুমিও আমাদের সঙ্গে বেরিয়ে পড়। কোনো হোটলে গিয়ে তোমার ভাইয়ার পকেট খালি করে দিই।
সেলিম বলল, তাই চল বাইরে কোথাও যাই। তারপর মনিরুলের দিকে একবার চেয়ে সকলের অলক্ষ্যে লাইলীর কানের কাছে মুখ নিয়ে খুব আস্তে আস্তে বলল, ওদের দুজনকে রেখে রেহানা ও রুবীনাকে সাথে করে বাইরে চলে এস।
লাইল আসমাকে বলল, আমরা বাইরে অপেক্ষা করছি। তুমি তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে এস।
ওরা বাইরে চলে যাওয়ার পর মনিরুলের দিকে আসমার লক্ষ্য পড়ল। দেখল, সে তার দিকে অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। এতক্ষণ দরজার পাশে দাঁড়িয়ে মনিরুল আসমাকে দেখে ভীষণ আশ্চর্য হয়ে তার দিকে তাকিয়েছিল। তার মনে তখন চিন্তার ঝড় বইছে। রেহানার মুখে সে একদিন শুনেছিল, আসমা নামে একটা মেয়ে সেলিমদের বইতে আছে। সেদিন নামটা শুনে মনে মনে চমকে উঠেছিল। পরে ভেবেছে আসমা নামে তো অনেক মেয়ে আছে। কিন্তু আজকে যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। তার মনে হল, এই দিন-দুপুরে স্বপ্ন দেখছে না তো? কিছুক্ষণ দুজন দুজনের দিকে চেয়ে রইল। আসমা নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, মনিরুল ভাই, আমাকে চিনতে পারছ?
মনিরুল কি বলবে ভেবে ঠিক করতে পারল না। তার মনের পর্দায় তখন অনেক দিন আগের কুমিল্লার একটা বাগান বাড়ির কথা মনে পড়ল। সেই বাগানে কত দিন এই মেয়েটার সঙ্গে প্রেম করেছে। শহরে ফিরে তার কথা ভুলে গিয়েছিল। তার জীবনে এমন কত মেয়ে আসে যায়, কটাকে মনে রাখবে। আজ আসমাকে দেখে তার বিবেক বলল, মনিরুল, তুমি এমন রন্সকে হারিও না। বুঝতে পারছ না, তোমার জন্য সে বাপ মায়ের দেশ ছেড়ে এসে কি রকম তপস্যা করছে। এখনও তোমার শুধরাবার সময় আছে।
তাকে চুপ করে থাকতে দেখে আসমা আবার বলল, বড়লোকেরা গরিবদের মানুষ বলে গণ্য করে না। তিন চার বছর আগের আসমাকে কি আর তোমার মনে আছে। এর মধ্যে কত আসমা তোমার জীবনে এসেছে। গরিবদের যতটুকু দয়া দেখাও, তা শুধু নিজেদের স্বার্থের খাতিরে। যেখানে স্বার্থ নেই সেখানে দয়াও নেই। মনে হচ্ছে,
জেনে তুমি এখানে এসে পড়েছ। আমি তোমার কাছে কোনো আব্দার বা দাবী করব না, শুধু ঐ ছেলেটাকে পিতৃত্বের পরিচয় দিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠা কর। তারপর মনিরুলের দু’পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল।
সেলিম ও লাইলী আসমার বুদ্ধির পরিচয় পেয়ে অবাক হল। রেহানা সব দেখেশুনে একেবারে থ হয়ে গেল। সে জানত, ভাইয়া মেয়েদেরকে নিয়ে একটু হৈ হুল্লোড় করে। তা বলে বন্ধুর বাড়ি বেড়াতে গিয়ে একটা গরিবের মেয়ের সর্বনাশ করে আসবে, সেকথা কল্পনাও করেনি। রেগে মেগে ঘরের ভিতরে যেতে উদ্যত হলে সেলিম তার একটা হাত ধরে আস্তে আস্তে বলল, এখনও সময় হয়নি, আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা কর।
এদিকে রুবীনাও ভীষণ রেগে গেল। কাল তাদের রেজেষ্ট্রি করে বিয়ে হওয়ার কথা। সে কোনো রকমে টলতে টলতে গাড়িতে গিয়ে বসল।
আসমা ঐ অবস্থায় বলে চলল, যখন আমি বুঝতে পারলাম মা হতে চলেছি তখন তোমাকে দিনের পর দিন পাগলের মত চিঠি লিখেছি। কিন্তু কোনো উত্তর পাইনি। শেষে তোক জানাজানির ভয়ে একরাত্রে ঘর থেকে পালিয়ে তোমার দেওয়া ঠিকানায় গেলাম। তোমাকে পেলাম না। পেলাম একজন বয়স্ক লোককে। মনে হয় তিনি তোমার বাবা। সব শুনে তিনি লাঞ্ছনা গঞ্চনা দিয়ে তাড়িয়ে দিলেন। তারপর অনেক ঘটনা ঘটেছে। শেষে সেলিম ভাই আশ্রয় দিয়ে নিজের বোনের মত দেখছে। তবে যত কিছু ঘটুক না কেন, আজ পর্যন্ত তুমি ছাড়া আর কেউ আমার শরীরে হাত দিতে পারেনি। জানি না, এসব তুমি বিশ্বাস করবে কিনা? যদি তুমি আমাকে আর তোমার ছেলেকে পথের কাঁটা বলে মনে কর, তবে খাবারের সঙ্গে বিষ মাখিয়ে এনে দিও। তাই খেয়ে তোমার আপদ দূর হয়ে যাবে।