একদিন লাইলী দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর বিছানায় গা এলিয়ে বেহেস্তী জেওর বইটি পড়ছিল। সেলিম চিটাগাং গেছে।
এমন সময় রেহানা ঘরে ঢুকে বলল, ভাবি ঘুমিয়ে গেছ নাকি রেহানা লাইলীর গুণে মুগ্ধ হয়ে তাকে মনেপ্রাণে ভালবেসে ফেলেছে। একদিন না দেখলে থাকতে পারে না। সে লাইলীর মহব্বতে ও তার কাছে ধর্মীয় জ্ঞান পেয়ে চাল চলন ও পোশাক-পরিচ্ছদ পরিবর্তন করে ফেলেছে। মন থেকে তার প্রতি হিংসা বিদ্ধেষ দূর করে দিয়েছে, পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ে। তাই প্রতিদিন বিকালে লাইলীর কাছে ছুটে আসে।
লাইলী বিছানার উপর উঠে বসে বলল, না ভাই ঘুমোইনি। তারপর বইটি দেখিয়ে বলল, এটা পড়ছিলাম। তুমিও পড়ো। এতে মেয়েদের অনেক শেখার জিনিষ আছে। এস, বস। আজ যে বড় তাড়াতাড়ি এসে গেছ।
রেহানা বলল, তুমি যে কি যাদু করেছ ভেবে পাইনি। সব সময় শুধু তোমার কথা মনে পড়ে। তারপর বিছানার উপর তার পাশে বসে আবার বলল, ভাবি বল না, তুমি যাদু জান কি না।
লাইলী বলল, না ভাই ওসব কিছু জানি না। তবে তোমাকে আমিও খুব ভালবেসে ফেলেছি। ওসব কথা বাদ দাও, আজ তোমাকে দুএকটা কথা বলব, তুমি যদি মনে কিছু না কর।
রেহানা বলল, তোমার কথায় আমি কিছু মনে করব না, তুমি নিশ্চিন্তে বল।
লাইলী বলল, দেখ বোন, আমার প্রায় মনে হয়, ওকে যেন আমি তোমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছি। এই চিন্তাটা আমার অন্তরে সব সময় কাটার মত বিধে। আল্লাহপাকের কসম করে বলছি, তোমার প্রতি আমার এতটুকু দুষমনি মনোভাব ছিল না, আজও নেই। আর আল্লাহপাককে জানাই ভবিষ্যতেও যেন না হয়। হঠাৎ কি করতে কি হয়ে গেল। আমরা দুজন দুজনকে ভালবেসে ফেললাম। তুমি নিউমার্কেটে একদিন এব্যাপারে কিছু কথা বলেছিলে। কিন্তু তখন বড় দেরি হয়ে গেছে। তা ছাড়া তার আগে আমি জানতাম না তোমাদের দুজনের সম্পর্ক। যাই হোক, তোমার কথা শুনে আমি দুরে সরে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু ওর কথা ভেবে পারিনি। আমি শত দুঃখ পেলেও সবকিছু সহ্য করতে পারতাম। কিন্তু তোমার দাদা তার অনেক আগে আমাকে স্পষ্ট করে বলেছিল, আলাহপাক ছাড়া দুনিয়ার কোনো শক্তি আমার কাছ থেকে তোমাকে দূরে সরিয়ে নিতে পারবে না। যদি তুমি নিজে সরে যাও তবে হয় আমি পাগল হয়ে যাব, নচেৎ আত্মহত্যা করে ফেলব। আমি তোমার দাদার পরিণতির কথা চিন্তা করে তোমার কথা রাখতে পারিনি। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও, নচেৎ চিরকাল এই অশান্তিতে ভুগব।
রেহানা ভেজা কণ্ঠে বলল, তুমি ক্ষমা চেয়ে আমাকে আরো বেশি অপরাধী করো। তুমি যে কত মহৎ, তা অন্ধ মোহের বশবর্তী হয়ে তখন বুঝিনি। আল্লাহ তোমাকে সেলিম ভাই-এর উপযুক্ত করে সৃষ্টি করেছেন। আমার মতো মেয়ে তার উপযুক্ত নয়। আমি ঈর্ষা ও রাগের বশবর্তী হয়ে নিউমার্কেট যাতা করে বলেছি এবং ফাংশানের দিনে নানাভাবে অপমান করার চেষ্টা করেছি। সেইসব কথা এখন মনে হলে মরমে মরে যাই। আমার সেইসব দুর্মতির জন্য এখন তোমার কাছে মাফ চাইছি বলে লাইলীর হাত ধরে কেঁদে ফেলল।
লাইলী রেহানাকে জড়িয়ে ধরে বলল, এ ব্যাপারে তোমার কোনো অন্যায় হয়নি। আর হলেও আমি কিছু মনে রাখিনি। আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করুন। তারপর নিজের আঁচল দিয়ে তার চোখ মুছে দেওয়ার বলল, চল বারান্দায় গিয়ে চা খেতে খেতে গল্প করা যাবে। ঘর থেকে বেরোবার সময় বলল, তুমি যদি বল, তা হলে তোমার জন্য পাত্র দেখতে পারি। আমার হাতে একটা খুব ভালো ছেলে আছে। সব দিক থেকে সে তোমার উপযুক্ত। রেহানা কিছু না বলে শুধু তার দিকে একবার চেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে চায়ের টেবিলে এসে বসল।
আরিফের জন্য মেয়ে ধোজ করা চলছে। সেদিন চায়ের টেবিলে সেও ছিল। লাইলী তাকে বলল, আমি তোমার জন্য একটা মেয়ে চয়েস করেছি।
আরিফ বলল, একটা কেন হাজারটা চয়েস কর, তাতে কোনো আসে যায় না। কিন্তু মনে রেখ, আজকাল কলেজ-ইউনিভার্সিটির মেয়েরা ধর্ম মেনে চলা তো দূরের কথা, ধর্মের নাম শুনলেই নাক ছিটকায়।
লাইলী বলল, সব মেয়েরা কি এক রকম হয়? হাতের পাঁচটা আঙ্গুল কি সমান? আমিও তো কলেজ-ভার্সিটিতে পড়েছি। তাদের মধ্যে ভালো মেয়েও আছে।
আরিফ বলল, ভাইয়াই তোমার সঙ্গে তর্কে পারেনি, আর আমি তো কোন ছার। অতশত বুঝি না, আপটুডেট ডিসকো–মিসকো মেয়ে হলে আমি তো অসুখী হই, আর তোমাদের সাথেও বনিবনা হবে না। শেষে সকলেই অশান্তি ভোগ করব।
লাইলী বলল, তা হলে তো তোমাকে তোমার ভাইয়ার মত গরিব ঘরের মেয়ে বিয়ে করতে হয়।
তা হোক, তাতেও আমি রাজি। আমি কি তোমাদের বলেছি নাকি, বড়লোকের মেয়েকে বিয়ে করব?
সোহানা বেগম সেখানে ছিলেন না। একটু আগে এসে দেওর ভাবির কথা শুনছিলেন। হেসে ফেলে আরিফকে উদ্দেশ্য করে বললেন, যে ধরনের মেয়ে আসুক না কেন, তুই যদি ঠিক থাকিস, তা হলে আমার মা লাইলী তাকে দুদিনেই মানুষ করে ফেলবে।
আরিফ মায়ের কথা শুনে লজ্জা পেয়ে রেহানার দিকে একপলক চেয়ে পালিয়ে গেল। রেহানাও তার দিকে চেয়েছিল, দুজনের চোখাচোখি হয়ে গেল।
লাইলী প্রায়ই লক্ষ্য করে ওরা মাঝে মাঝে একে অপরের দিকে গোপনে গোপনে তাকায়। আজকের ঘটনার পর থেকে তার মনে যেন একটু সন্দেহ হল।
————-
(১) বর্ণনায় আবু হোরাইরা (রাঃ)-তিরমিজী।
১০. আসমা ফার্ষ্ট ডিভিসনে আই. এ. পাশ করল
আসমা ফার্ষ্ট ডিভিসনে আই. এ. পাশ করল। সেলিম তাকে জয়দেবপুরে কনভেন্ট স্কুলে প্রাইমারী সেকশানে মাষ্টারী পাইয়ে দিল। সে ছেলেকে নিয়ে সেখানে থাকে। আর প্রাইভেটে বি. এ পরীক্ষা দেবার জন্য পড়াশোনা করতে লাগল। প্রতি সপ্তাহে ছুটির দিনে ছেলেকে নিয়ে সে সেলিমদের বাড়িতে আসে। এক ছুটির দিন স্কুলে ফাংশান ছিল বলে আসতে পারল না। সেলিম গত রাত্রে বাড়ি ফিরেছে। দুপুর পর্যন্ত আসমা এল না। বেলা তিনটার দিকে মনিরুল এসেছে। সে আজ রুবীনাকে নিয়ে কোথায় যেন যাবে। সেলিম খাওয়া দাওয়া সেরে শুয়ে শুয়ে একটা বই পড়ছিল। লাইলী সবাইকে খাইয়ে নিজেও খেল। তারপর হাতের কাজ সেরে স্বামীর পাশে এসে বসে বলল, একটা কথা বলব তুমি যেন আবার মাইন্ড করো না?