সেলিমের কথা শুনে হামিদা বানু চোখের পানি রোধ করতে পারলেন না। বললেন, আল্লাহ তোমাদের সুখে রাখুন। তোমাকে আমিও ছেলের মত জানি। আমি স্বামীর ভিটে ছেড়ে অন্য জায়গায় গিয়ে শান্তি পাব না। আর তোমার মত জামাই পেয়েছিলে আমার নয়নের পূতলী লাইলীর জন্য কোনো চিন্তা নেই। তোমরা সময় করে দুজনে এসে আমাকে দেখা দিয়ে যেও। তা হলেই আমি খুশি হব, শান্তি পাব।
লাইলী মাকে সালাম করে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল।
সেলিম বলল, লাইলী তুমি কাঁদছ? কোথায় তুমি মাকে শান্তনা দেবে? তা না করে নিজেই ভেঙে পড়ছ?
লাইলী সেলিমের কথা শুনে সামলে নিয়ে মাকে ছেড়ে দিয়ে তার চোখ বলল, তুমি কেঁদ না মা? কোনো চিন্তাও করো না, আমি প্রায়ই আসব।
সেলিমও শাশুড়ির পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠল।
কিছু দিনের মধ্যে সোহানা বেগম সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলেন। তিনি লাইলীকে যতই দেখছেন ততই মুগ্ধ হচ্ছেন আর ভাবছেন, কে বলবে, সে একজন সাধারণ ঘরের মেয়ে। আচার-ব্যাবহারে, চাল-চলনে, কথা-বার্তায় এবং আদর আপ্যায়নে সর্ব বিষয়ে পারদর্শী। কেউ তার কোনো কিছুতে এতটুকু দোষ ধরতে পারেনি। লাইলীকে পত্রবধূ হিসাবে পেয়ে সোহানা বেগম যেমন আনন্দিত তেমনি গর্বিতও।
কোটিপতির ছেলে সেলিম। উচ্চশিক্ষিত ও আল্টামডার্ণ সোসাইটিতে মানুষ হয়ে একটা গরিব ঘরের সেকেলে আনকালচার্ড মেয়েকে বিয়ে করেছে শুনে অনেক উচ্চশিক্ষিত ও আল্টামডার্ণ বন্ধু-বান্ধবী লাইলীকে দেখার জন্য তাদের বাড়িতে আসে। বন্ধুদের মধ্যে অনেকে তাদের সুন্দরী অর্ধনগ্ন বোন অথবা স্ত্রীকে সঙ্গে করে নিয়ে আসে সেলিমকে ক্রিটীসাইজ করার উদ্দেশ্যে। কিন্তু যখন সেই আটপৌরে মেয়ে সাধারণ পোশাকে গায়ে মাথায় কাপড় দিয়ে স্বামীর সঙ্গে তাদের অভ্যর্থনা করে তখন তাকে দেখে, তার মার্জিত ভাষা শুনে ও সুমিষ্ট ব্যাবহারে তারা মুগ্ধ হয়ে যায়। তাদের সেই ঈর্ষা ও রাগ কোথায় যেন উড়ে যায়। অর্ধনগ্ন মেয়েরা তাদের শরীরের খোলা অঙ্গগুলো ঢেকে দেয়। তারা লাইলীকে যত দেখে, তার সঙ্গে যত কথা বলে ততই তারা আকৃষ্ট হতে থাকে। শেষে সবাই তাকে তাদের মনের উচ্চ আসনে বসায়, যেখানে কোনো হিংসা, বিদ্বেষ ও ক্রিটিসাইজ মনোভাবের স্থান নেই। বাড়ি ফেরার সময় প্রত্যেকে তাকে সাদর নিমন্ত্রণ করে। বন্ধুরা বলে, সত্যি সেলিম, তোর মতো ভাগ্য আর কারো হয় না। আলাহ তোদের দুজনকে ঠিক যেন এক বৃন্তে দুটো ফুল করে সৃষ্টি করেছেন। তোরা দুজনে একে অন্যের জন্য সৃষ্টি হয়েছিস। তোদের মতো এত সুন্দর মিল, সারা পৃথিবীতে আর আছে কি না সন্দেহ। ঐ দলে রেহানা আর মনিরুলও থাকে। তাদের মনেও আর কোনো ঈর্ষা বা রাগ নেই। লাইলীর ব্যাবহারে সব দূর হয়ে গেছে।
একদিন রেহানা লাইলীকে আসমার কথা উত্থাপন করে সেদিনের ঘটনাটা বলল।
লাইলী বলল, আসমার পরিচয় পেলে তুমি চমকে উঠবে। আর তোমার সেলিম ভাই-এর কথা যে বলছ, ওর চেয়ে চরিত্রবান ছেলে এ পৃথিবীতে আছে কি না সন্দেহ। তোমাকে একটা কথা বলি শোন, কখন পরের ছিদ অন্বেষণ করবে না বরং অন্যের ভালো গুণগুলো দেখবে। অন্যের কোনো দোষ দেখলে নিজের দিকে লক্ষ্য করবে। দেখবে তোমার সে দোষ আছে কিনা। যদি থাকে তবে তা সংশোধন করার চেষ্টা করবে। হাদিসে আছে, রাসূলুল্লাহ (দঃ) বলিয়াছেন, “যে অন্যের দোষ পাঁচ জনের কাছে প্রকাশ না করে তার সম্মান বাঁচায়, কাল হাশরের ময়দানে আল্লাহ পাকও তার অনেক গুনাহ গোপন রাখবেন, যা মিজানের পাল্লায় দিলে সে জাহান্নামী হত।”(১)
রেহানা লাইলীর কথা শুনে খুব খুশি হল। জিজ্ঞেস করল, আসমার পরিচয় পেলে চমকে উঠব কেন
সে কথা এখন বলতে পারব না, তোমার ভাইয়ের নিষেধ। তবে চিন্তা কর না, খুব শিঘী তার পরিচয় প্রকাশ হয়ে পড়বে।
মনিরুল ইদানিং এ বাড়িতে যাতায়াত শুরু করেছে। প্রায় প্রতিদিন রুবীনা কলেজ থেকে ফেরার সময় আসে। তার সঙ্গে গল্প করে। মাঝে মাঝে দুজনে গাড়ি নিয়ে বেড়াতে যায়।
সেলিম এর মধ্যে কয়েকবার চিটাগাং গিয়েছে। দুই একদিনের বেশি সেখানে থাকতে পারে না। এক রাতে চিটাগাং থেকে ফিরে লাইলীকে বলল, মা তো ভালো হয়ে গেছে। তুমি এবার আমার সঙ্গে চিটাগাং চল। এ রকম দু’একদিন ছাড়া যাতায়াত করে অফিসের অনেক ক্ষতি হচ্ছে।
লাইলী বলল, তুমি নিয়ে গেলেই যাব। তবে মায়ের শরীর আর একটু ইমপ্রুভ করলে তারপর গেলে ভালো হত।
সেলিম বলল, বেশ তাই হোক। গৃহকর্তি লাইলী আরজুমান বানুর কথা কি অমান্য করতে পারি।
তুমি আমার পুরো নাম জানলে কেমন করে।
কেন কাবিননামা লেখার সময় জেনেছি। সত্যি তোমার নামটাও তোমার মতই অপূর্ব সুন্দর। যিনি তোমার এই নাম রেখেছিলেন, তাঁকে জানাই শত শত ধন্যবাদ।
রেহানাও মনিরুলের মতো ঘন ঘন এ বাড়িতে আসতে শুরু করেছে। আগে সে সেলিমের সঙ্গে বেড়াতে যেত, ব্যটমিন্টন খেলত। এখন লাইলীর সঙ্গে গল্প করে। বিকেলে চায়ের আসরে গল্প বেশ জমে উঠে। লাইলী তাদেরকে কোরআন ও হাদিসের অনেক উপদেশ মূলক গল্প বলে এবং ইসলামের কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ইসলামের মহান আদর্শের দৃষ্টান্ত দেয়। সোহানা বেগমও সেই সব শোনেন লাইলার চেষ্টায় এবাড়ির সকলে নামাজ পড়ছে। শুধু রুবানা ধরব ধরব করছে।