লাইলী মৃদু হেসে বলল, হয়েছে হয়েছে, বাবুর রাগ দেখ না? আমি আর কোনোদিন তোমার সঙ্গে তর্ক করব না। স্বামীর হুকুম সবসময় মেনে চলব।
লাইলীর হাসিটা বিদ্যুতের মতো সেলিমের মনে আনন্দের ঝিলিক দিল। সে তাকে জড়িয়ে ধরে সোহাগ করতে করতে বলল, আমি তোমাকে ছেড়ে আর একটা রাতও থাকতে পারব না।
লাইলী আবার মৃদু হেসে বলল, আমিও পারি নাকি? তুমি অনেক দূর থেকে গাড়ি চালিয়ে এসে ক্লান্ত হয়েছ। প্রথম অর্ধেক রাত্রি তুমি ঘুমাও, আমার ঘুম পেলে তোমাকে না হয় জাগিয়ে মায়ের কাছে রেখে এসে তারপর আমি ঘুমাব।
সেলিম তার গালটা আস্তে করে টিপে ছেড়ে দিয়ে বলল, সব সময় জিতবেই, একবারও হারাতে পারলাম না। তারপর পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল।
লাইলী মশারী খুঁচে দিয়ে শাশুড়ীর ঘরে এসে দেখল, তিনি তখনও ঘুমোচ্ছেন। মাথায় হাত দিয়ে বুঝতে পারল জ্বর বেশি উঠেছে। চার্টে লেখা আছে টেম্পারেচার বেশি উঠলে মাথায় বরফ দিতে হবে। লাইলী আইস ব্যাগে বরফ
ভরে মাথায় দিতে লাগল।
রাত তখন সাড়ে বারোটা, লাইলী আইস ব্যাগ শাশুড়ীর মাথায় ধরে বসে আছে। আরিফ ঘরে ঢুকে কয়েক মুহূর্ত লাইলীর শান্ত সৌম্য মুখের দিকে চেয়ে কাছে এসে বলল, ভাবি, আপনি এখনও জেগে আছেন? গত কয়েক রাত জেগে আজ একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। এবার আপনি ঘুমোতে যান, আমি মায়ের কাছে বসছি।
লাইলী বলল, ভাবিকে কেউ আপনি করে বলে না। তারপর বলল, তুমি ঘুমাওগে যাও। আমার জন্য ভেব না, মেয়েদেরকে রাত জেগে সেবা করার ক্ষমতা ও ধৈৰ্য্য দিয়ে আল্লাহপাক তৈরি করেছেন। রাত জাগলে পুরুষদের শরীর ভেঙ্গে যায়। তা ছাড়া তোমরা এতদিন মায়ের সেবা করেছ, এবার আমাকে কিছু করতে দাও। যাও সোনা ভাই, ঘুমাওগে যাও। বড়দের কথার অবাধ্য, সুবোধ ছেলেরা হয় না। আমার অসুবিধা হলে তোমার ভাইয়াকে ডেকে নেব।
ভাবির কথা শুনে আরিফ মনে বড় শান্তি পেল। তখন তার ভাইয়ার সেদিনের কথা মনে পড়ল, “জানিস আরিফ, আমাদের সোসাইটির কলেজ ইউনিভার্সিটির কত মেয়ের সাথে তো পরিচিত হয়েছি, কিন্তু লাইলীর সঙ্গে তাদের তুলনা হয় না, লাইলী অনন্যা।”
তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে লাইলী আবার বলে উঠল, বড়দের কথার অবাধ্য হওয়া যে বেয়াদবী, তা তো তুমি আমার থেকে ভালো জান।
আরিফ নিজেকে সংযত করতে পারল না, অশ্রুসিক্ত নয়নে ভক্তি গদগদ কণ্ঠে বলল, যাচ্ছি ভাবি, জীবনে কোনোদিন তোমার কথার অবাধ্য হওয়ার ধৃষ্টতা যেন
আমার না হয়। তারপর হনহন করে চলে গেল।
ফজরের আজান শুনে লাইলী নিজের ঘরে এসে স্বামীকে জাগিয়ে বলল, আজান হয়ে গেছে; তুমি নামায পড়ে মায়ের কাছে এসে বসবে। আমিও নামায পড়ব। এখনও বরফ দিতে হচ্ছে। রাত্রে জ্বর খুব বেশি উঠেছে, এখনও কমেনি। ডাক্তারকেও একবার কল দিতে হবে।
সেলিম তাড়াতাড়ি করে উঠে বলল, তোমার প্রতি খুব অবিচার করলাম। আমি নিজের ছেলে হয়ে স্বার্থপরের মত ঘুমালাম। আর তুমি বৌ হয়ে আমার মাকে সারারাত জেগে সেবা করলে?
লাইলী বলল, এতে তোমার কোনো অপরাধ হয়নি। তোমাকে বিশ্রাম করতে দেওয়া এবং মায়ের সেবা করা দুটোই আমার কর্তব্য। আমি তা করতে পেরে খুব আনন্দিত। এতে তোমার লজ্জা বা অনুশোচনা করার কিছু নেই।
দিন-রাত চব্বিশ ঘন্টা লাইলী শাশুড়ির সেবা করে চলছে। তারই ফাঁকে ফাঁকে স্বামীর প্রতি কর্তব্যও করছে। এইভাবে অক্লান্ত পরিশ্রম করে লাইলী শাশুড়ির সেবা করে চলল। প্রায় বিশ পঁচিশ দিন যমে মানুষে টানাটানি করার পর সোহানা বেগম এখন আরোগ্যের পথে।
আরো কয়েক দিন পর একদিন সকালের দিকে হামিদা বানু সোহানা বেগমের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মেয়ে জামাইকে সঙ্গে করে র্যাংকীন স্ট্রীটে নিজের বাড়িতে এলেন।
সবাইকে দেখে রহিমা ও জলিল সাহেব খুশি হলেন। সেরেলা রহিমা তাদেরকে রান্না করতে দিল না। দুপুরে খুব ধুমধামের সঙ্গে খাওয়া দাওয়া হল। এক ফাঁকে রহিমা লাইলীকে একান্তে ডেকে নিয়ে বলল, কি সখি, সখাকে কেমন লাগছে? একেই বলে সত্যিকারের প্রেম। তা না হলে যার সঙ্গে একবার বিয়ে ভেঙ্গে যায়, তার সঙ্গেই আবার বিয়ে। হাদিসে আছে, সাতী সাধ্বী নারীর মনের বাসনা আল্লাহ পূরণ করেন। হাদিস তো মিথ্যা হতে পারে না
লাইলী প্রথমে লজ্জায় কথা বলতে পারল না। একটু সময় নিয়ে বলল, দোয়া কর ভাবি, আমি যেন তাকে সুখী করতে পারি।
জীবনে অনেক দুঃখ পেয়েছ। দোয়া করি ভাই, আল্লাহপাক তোমাদের দাম্পত্য জীবন সুখের করুন।
সাদেক ও ফিরোজা লাইলীকে জড়িয়ে ধরে বলল, তুমি আমাদেরকে ছেড়ে দাদিকে নিয়ে কোথায় চলে গিয়েছিলে? আবার যাবে না তো?
রহিমা ছেলে মেয়েকে বোঝাল, তোমাদের ফুপু আম্মার বিয়ে হয়ে গেছে। সে তো তার শ্বশুর বাড়িতে যাবেই। তবে তোমাদের দাদি থাকবেন।
রাত্রে খাওয়া দাওয়ার পর হামিদা বানু কাঁদতে কাঁদতে মেয়ে জামাইকে বিদায় দিলেন।
সেলিম বলল, মা আপনি কাঁদবেন না। যখনই আপনার মন খারাপ হবে অথবা প্রয়োজনবোধ করবেন তখনই খবর দেবেন। আমি ঘরে না থাকলেও আপনার মেয়ে চলে আসবে। ছেলের অপরাধ যদি না নেন, তা হলে বলি, আমার ইচ্ছা আপনি আপনার মেয়ের সঙ্গে সব সময় থাকুন। আপনিও আমার মা। ছেলেকে মায়ের সেবা করার সুযোগ দিয়ে আমাকে ধন্য করুন।