রাত্রি আটটায় ওরা ঢাকার বাড়িতে এসে পৌঁছাল। গাড়ির শব্দ শুনে আরিফ, রুবীনা ও আসমা ঘর থেকে বেরিয়ে এল। তারা এতক্ষণ সোহানা বেগমের কাছে ছিল। তার আজ এক সপ্তাহ খুব জ্বর। গতকাল ডাক্তার বলেছে, টাইফয়েডের লক্ষণ। তাই আরিফ সেলিমকে আসার জন্য ট্রাঙ্কল করেছিল। সেলিমের সঙ্গে লাইলীকে এবং আধা বয়সী একজন মহিলাকে দেখে ওরা সবাই অবাক হয়ে গেল।
সেলিম আরিফের সঙ্গে সালাম বিনিময় করে লাইলীকে দেখিয়ে বলল, তোদের ভাবি, আর উনি আমার শ্বাশুড়ী।
আসমা একরকম ছুটে এসে লাইলীকে জড়িয়ে ধরে বলল, ভাবি আপনি কেমন আছেন
সেলিম বলল, আসমা কি হচ্ছে? আগে মায়ের কাছে চল, মা কেমন আছে?
আসমা ভাবিকে ছেড়ে দিল। আরিফ ডাক্তারের কথাগুলো বলল। সকলে সোহানা বেগমের ঘরে এসে ঢুকল। উনি শুয়ে ছিলেন। জ্বর এখন একটু কম, রাত্রে বেশি বাড়ে। ওদের দেখতে পেয়ে আস্তে আস্তে উঠে হেলান দিয়ে বসলেন।
সেলিম মায়ের পায়ের কাছে বসে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে বলল, তুমি এখন কেমন আছ মা সোহনা বেগম ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে চুমো খেয়ে বললেন, এখন একটু সুস্থ বোধ করছি।
ততক্ষণে লাইলী এসে সোহানা বেগমের পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, আপনি আমাদের দুজনকে মাফ করে দিন মা।
সোহানা বেগম সবকিছু বুঝতে পারলেন। তিনি লাইলীকে জড়িয়ে ধরে তার মাকে কাছে এসে বসতে বলে বললেন, তোমরা কোনো অন্যায় করনি। যা কিছু করেছি আমি। তোমাদেরকে ভুল বুঝেছিলাম। সেলিম ভালো হয়ে সেদিন যে কথা বলেছে, তাতেই আমার ভুল ভেঙ্গে গেছে। তারপর হামিদা বানুর হাত ধরে বললেন, বেয়ান সাহেবা, আপনি আমাকে মাফ করে দিন। লাইলীর আব্বা এলেন না যে, তিনি বুঝি এখনও আমার উপর রাগ করে আছেন?
সেলিম বলল, মা তিনি অনেকদিন আগে ইন্তেকাল করেছেন।
সোহানা বেগম অশ্রুসিক্ত নয়নে বললেন, আল্লাহ তার ভালো করুন। সেদিন তার প্রতি ভালো ব্যবহার করিনি। তার কাছে ক্ষমা চাওয়া হল না। তারপর আঁচলে চোখ মুছে সকলের দিকে তাকিয়ে বললেন, হ্যারে, এ বাড়ির বড় বৌ প্রথম বাড়িতে এল, তোরা একটু আনন্দ করবি না? আরিফকে বললেন, তুই দোকান থেকে মিষ্টি আনতে দে। আর তোমরা সব দাঁড়িয়ে আছ কেন? বৌমাকে তার ঘরে নিয়ে যাও, অনেক দুর থেকে এসেছে, বিশ্রাম করুক।
লাইলী বলল, আম্মা, আপনি ওসব নিয়ে কিছু ভাববেন না। তারপর সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল, তোমরা এখন এ ঘর থেকে যাও। অসুস্থ শরীরে মানসিক টেনশন এলে মায়ের ক্ষতি হতে পারে।
লাইলীর কথায় যেন একটা আদেশের সুর রয়েছে। আর কথাটা এমনভাবে বলল, তা কেউ অমান্য করতে পারল না। সেলিম সবাইকে নিয়ে চলে গেল।
সকলে বেরিয়ে যাওয়ার পর লাইলী শাশুড়ীর বিছানা ঝেড়ে ঠিক করে দিয়ে তাকে শুইয়ে দিল। চার্ট দেখে ঔষধ খাইয়ে টেম্পারেচার দেখে চার্টে লিখে রাখল। তারপর পায়ের কাছে বসে পায়ে হাত বুলোত বুলোতে বলল, আপনি আর একদম কথা বলবেন না, ঘুমোবার চেষ্টা করুন। আমি ঠিক সময় মত পথ্য ও ঔষধ খাওয়াব।
সোহানা বেগম নিজেকে সংযত করতে পারলেন না। তার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল। ধরা গলায় বললেন, ঠিক যেন আমার মা। জান মা, ছোট বেলায় আমার যখন জ্বর জ্বালা হত তখন আমার মাও ঠিক এই রকম করত।
লাইলী মিষ্টি ধমকের স্বরে বলল, আপনাকে কোনো কিছু চিন্তা করতে ও কথা বলতে নিষেধ করলাম না? নিজের আঁচল দিয়ে তার চোখ মুছে দিয়ে আবার বলল, ঘুমোনার চেষ্টা করুন মা।
সোহানা বেগম আর কথা বললেন না। চোখ বন্ধ করে চিন্তা করলেন, এত সুন্দর ও গুণবতী মেয়েকে ভুল বুঝে তার নামে কত দুর্ণাম দিয়েছি। আল্লাহ কি আমাকে ক্ষমা করবেন তিনি মেয়েটির মধ্যে কি জিনিষ দিয়েছেন মুহূর্তের মধ্যে সবাইকে বাধ্য করে ফেলল।
লাইলী যখন বুঝতে পারল উনি ঘুমিয়ে গেছেন, তখন ধীরে ধীরে খাট থেকে নেমে কম্বলটা বুক পর্যন্ত টেনে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল।
এতক্ষণ আরিফ রুবীনা ও আসমা সেলিমের কাছ থেকে লাইলীকে কি করে খুঁজে বের করে বিয়ে করল, সে সব কথা শুনছিল।
লাইলী সেখানে এসে দাঁড়াতে আরিফ প্রথমে তার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করল। তার দেখাদেখি আসমা ও রুবীনা করল।
লাইলী বলল, আল্লাহ সবাইকে হেদায়েত দান করুন। তিনি আমাদের সবাইকে সব রকম বিপদ-আপদ থেকে হেফাজত করুন। তারপর বলল, রাত অনেক হয়েছে, আর গল্প নয়, সকলে এশার নামাজ পড়ে খাওয়া দাওয়ার কাজ সেরে নাও। মায়ের অসুখ, সে কথা সকলের মনে রাখা উচিৎ।
আরিফ মাঝে মাঝে ভাবির দিকে না চেয়ে থাকতে পারছে না। দেখা অবধি ভাবিকে মানবী বলে বিশ্বাস করতে পারছে না। শুধু চিন্তা করছে, কোনো মানবী তো এত রূপবতী ও গুণবতী হতে পারে না। তার কথাগুলো যেন শুনতে মধুর মতো লাগে। তাকে সে মনের মধ্যে খুব উচ্চ আসনে বসিয়ে ফেলল।
খাওয়া দাওয়ার পর লাইলী বিছানা ঠিক করে মশারী খাটিয়ে স্বামীকে বলল, তুমি ঘুমাও। আমি মায়ের কাছে থাকব।
সেলিম বলল, তুমি ঘুমাও, আমি আমার মায়ের কাছে থাকব।
বিয়ের পর স্বামীর সবকিছুর উপর স্ত্রীর অধিকার হয়ে যায়। উনি এখন আমারও মা। তা ছাড়া স্ত্রীর কর্তব্য স্বামীর আরামের দিকে সর্বদা লক্ষ্য রাখা।
সেলিম কৃত্রিম রাগের সঙ্গে বলল, আর স্বামী বুঝি স্ত্রীর আরামের দিকে লক্ষ্য রাখবে না? আমি অতশত বুঝতে চাই না, তোমার সঙ্গে তর্কে কোনোদিন জিতেছি? আমিও তোমার সঙ্গে মায়ের কাছে থাকব। তোমার হুকুম বাড়ির সকলের উপর চালিও কিন্তু আমার উপর নয়। তা ছাড়া স্ত্রীর কর্তব্য স্বামীর হুকুম মেনে চলা।