সেলিম লাইলীর আঁচল দিয়ে প্রথমে তার চোখ মুখ মুছে দিয়ে পরে নিজেরটা মুছতে মুছতে বলল, দু’জন প্রেমিক প্রেমিকা প্রেমের সাগরে ডুব দিয়েছিল। সাগরে তো পানি থাকবেই। তারপর তারা দু’টো চেয়ারে সামনা-সামনি বসে একে অপরের দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। কিছুক্ষণ পর লাইলী বলল, এভাবে বসে থাকলে চলবে? ওদিকে মা ভীষণ চিন্তা করছে।
মায়ের কথা শুনে সেলিম জিজ্ঞেস করল, উনি এখন কেমন আছেন?
লাইলী বলল, একটু ভালোর দিকে।
তোমার হোটেলের ফোন নাম্বার ও রুম নাম্বারটা বল, মায়ের চিন্তা দূর করে দিই।
লাইলী ফোন নাম্বার বলল।
সেলিম ডায়েল করে হোটেলের ম্যানেজারকে বলল, এত নাম্বার রুমে দিন তো। তারপর লাইলীর হাতে রিসিভার দিয়ে বলল, মায়ের সঙ্গে কথা বল। বলবে তোমার ফিরতে আরও দেরি হবে, উনি যেন চিন্তা না করেন।
লাইলী সেলিমের কথামতো মায়ের সঙ্গে কথা বলে রিসিভার নামিয়ে রেখে বলল, আরো কত দেরি করাবে?
সেলিম বলল, আরও কিছুক্ষণ বস না, প্রাণ ভরে দেখি। বহুদিন পর তোমাকে পেলাম। ছাড়তে মোটেই মন চাইছে না। কি করি বল দেখি? আচ্ছা, আমাকে ছেড়ে যেতে তোমার মনে চাইছে?
লাইলী বলল, না। তোমাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা মনে করলে কলজে মোচড় দিয়ে উঠছে। কিন্তু মায়ের কথা ভেবে নিজেকে সংযত করতে হচ্ছে।
সেলিম বলল, এক্ষুণি তোমাকে ছাড়ছি না। একবার ছেড়ে যা ভোগান ভুগিয়েছে, আর নয়। আগে বাঁধব, তারপর যা হয় হবে। তারপর ব্রিফকেস খুলে কিছু টাকা নিয়ে লাইলীকে সঙ্গে করে একটা বেবী ট্যাশ্রীতে উঠে বলল, কাজি অফিসে চল।
ডাইভার বলল, এখন তো কাজি অফিস বন্ধ হয়ে গেছে, স্যার।
হোক বন্ধ, আপনি চলুন।
ড্রাইভার কাজি অফিসের সামনে গাড়ি পার্ক করল।
সেলিম তাকে অপেক্ষা করতে বলে লাইলীকে নিয়ে অফিসের সামনে গিয়ে দেখল বন্ধ। তবে দরজার ফাঁক দিয়ে আলো দেখা যাচ্ছে। সে দরজায় ধাক্কা দিতে একজন প্রবীণ লোক বেরিয়ে এসে তাদেরকে দেখে বললেন, এখন অফিস বন্ধ হয়ে গেছে, আগামীকাল সকাল আটটায় আসুন।
সেলিম বলল, দেখুন আমরা ভোরেই এখান থেকে চলে যাব। আপনাকে অফিসের টাইমের বাইরে কাজ করার জন্য ওভার টাইম দেব। আপনি দয়া করে আমাদের কাজটা করে দিন।
কাজি সাহেব বললেন, সরকারী রেটের চেয়ে ডবল দিতে হবে। আর দুজন সাক্ষীর জন্য আলাদা চার্জও দিতে হবে।
সেলিম সবকিছুতে রাজি হয়ে ওদের বিয়ের কাবিন রেজিষ্ট্রি করে নিল। তারপর গাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে বলল, একটা ভালো হোেটলের সামনে রাখবেন। আর লাইলীকে বলল, খেয়ে দেয়ে তোমাকে মায়ের কাছে পৌঁছে দেব। খাওয়া দাওয়া সেরে ওরা যখন হোটেলে পৌঁছাল তখন রাত্রি দশটা।
সেলিমকে সঙ্গে করে লাইলী যখন রুমে ঢুকল তখন হামিদা বানু ওজিফা শেষ করেছেন। সেলিমকে দেখে অবাক হয়ে ঘোমটা টেনে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ততক্ষণে লাইলী ও সেলিম একসঙ্গে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করল। তারপর সেলিম বলল, আজ আমাদের কাবিন হয়ে গেছে। বাকি কাজ আগামীকাল চিটাগাং-এ গিয়ে সেরে নিতে চাই। আপনি আমাদেরকে দোয়া করুন মা।
সেলিমের কথা শুনে হামিদা বানু আরো অবাক হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তিনি যেন কিছু বিশ্বাস করতে পারছেন না।
ওকে চুপ করে থাকতে দেখে সেলিম আবার বলল, আমার অসুখের সময় আমার মা আপনাদেরকে ভুল বুঝে অনেক খারাপ ব্যবহার করেছেন। আমি সেজন্য খুব দুঃখিত। অনুগ্রহ করে আমাদের সবাইকে মাফ করে দিন। আমি এসবের কিছুই জানতাম না। এ্যাকসিডেন্ট করে যখন স্মৃতিশক্তি ও বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলাম তখন চিকিৎসার জন্য সাত মাস বিদেশ ছিলাম, তাই এইরুপ অঘটন ঘটে গেছে। আপনার ছেলে যদি অন্যায় করে মাফ চাইত, তা হলে কি তাকে মাফ করতেন না? সেলিমের শেষের দিকের কথাগুলো কান্নার মত শোনাল। লাইলীর চোখ দিয়ে পানি টপটপ করে পড়তে লাগল।
হামিদা বানুর চোখও পানিতে ভরে উঠল। চোখ মুছে বললেন, সবই আল্লাহপাকের ইচ্ছা বাবা, তিনি তোমাদের মাফ করুন। আমরাও তোমাদেরকে ভুল বুঝে অন্যায় করেছি।
সেলিম বলল, না, না আপনারা কোনো অন্যায় করেননি। এই রকম ঘটনা ঘটলে সবাই তাই করতো। আমার মা যে ভুল করেছেন, সেটা আমি শুধরোতে চাই। আপনি আজ বিশ্রাম নিন। তারপর লাইলীর দিকে চেয়ে বলল, তুমি ভোরে উঠে সব গুছিয়ে নিয়ে রেডি হয়ে থাকবে। আমি এসে তোমাদেরকে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যাব। আমরা কাল ফাষ্ট ফ্লাইটে চিটাগাং যাব। তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হোটেলে নিজের রুম ফিরে এসে এয়ারপোর্টে ফোন করে তিনটি টিকিট বুক করল। পরেরদিন ভোর ছ’টার প্লেনে সেলিম লাইলীকে ও হামিদা বানুকে নিয়ে প্রেনে উঠল।
বেলা আটটার সময় সাহেবকে দুজন মহিলাসহ গাড়ি থেকে নামতে দেখে জাভেদ দোতলা থেকে ছুটে নেমে এল। তখনও অফিস খুলেনি। বেলা নয়টায় অফিস খুলে। সেলিম জাভেদকে আসসালামু আলাইকুম দিয়ে বলল, গাড়ি থেকে সব মালপত্র নিয়ে উপরে এস।
সাহেবকে আগে সালাম দিতে শুনে জাভেদ লজ্জায় এতটুকু হয়ে সালামের উত্তর দিতে ভুলে গেল।
সেলিম তার অবস্থা দেখে বলল, এতে লজ্জা বা অবাক হওয়ার কিছু নেই। হাদিসে আছে না যে আগে সালাম দিবে সে উত্তর দাতার চেয়ে নই গুণ সওয়াব বেশি পাবে? তারপর সে ওদেরকে নিয়ে উপরে চলে গেল।