ম্যানেজার চাচা,
প্রথমে সালাম নেবেন। পরে জানাই যে, আজকের সন্ধ্যার ফ্লাইটে বিশেষ কারণবশতঃ আমি কক্সবাজারে যাচ্ছি। ফিরতে দুচার দিন দেরি হতে পারে? আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। ইনশাআল্লাহ আমি শীঘ্রি ফিরে আসব।
ইতি–
সেলিম।
সেলিমের বাসার কাজ-কর্ম ও রান্না-বান্না করার জন্য জাভেদ নামে একজন লোককে ম্যানেজার সাহেব ঠিক করে দিয়েছেন। লোকটা খুব বিশ্বাসী। সাহেব আসবে শুনে সে আগে থেকে ঘর-দরজা, বিছানাপত্র সব পুরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করে রেখেছিল। তার আর একটি বড় গুণ, সে খুব ভালো রান্না করতে পারে। সেলিম প্রথম তার হাতের রান্না খেয়েই বুঝতে পেরেছে, লোকটি আগে বোধ হয় কোনো বড় হোটেলের বাবুর্চি ছিল। সে চিঠিটা শেষ করে জাভেদের হাতে দিয়ে বলল, কাল ঠিক নটার সময় এটা ম্যানেজার সাহেবের হাতে দেবেন। আর আমি আজ কক্সবাজার যাচ্ছি, কয়েকদিন পর ফিরে আসব।
সেইদিন সন্ধ্যার ফ্লাইট সেলিম কক্সবাজারে গিয়ে পৌঁছাল। রাত্রে হোটেলে শুয়ে শুয়ে সে চিন্তা করল, কি করে লাইলীকে খুঁজে বের করবে। এই শহরে কোথায় আছে কি করে সে জানবে? পরের দিন সে সমস্ত হোটেলে গিয়ে তাদের রেজীষ্টার খাতা চেক করে দেখল, কিন্তু কোথাও লাইলীর নাম খুঁজে পেল না। সেলিম যদি লাইলীর মায়ের নাম জানত, তা হলে পেত। কারণ লাইলী মায়ের নামে রুম নিয়েছে। সারাদিন এলোমেলোভাবে ঘুরে সন্ধ্যার দিকে সে সমুদ্র তীরে গেল। তখন সূর্যাস্তের সময়। সেলিম সূর্যাস্তের অলৌকিক শোভা দেখতে লাগল। সূৰ্য্য যখন একটা বড় থালার মত টকটকে লাল হয়ে ডুবতে আরম্ভ করল তখন সেলিমের মনে হল, একটা বিরাট রক্তগোলাপ যেন ধীরে ধীরে সমুদ্রের মাঝখানে ডুবে যাচ্ছে। তার লাল কিরণছটাতে সমুদ্রের পানিও রক্তের মত লাল হয়ে গেছে। সে যে কি এক অপূর্ব দৃশ্য, তা যে দেখেছে, সে ছাড়া আর কেউ অনুভব করতে পারবে না। একটু পরে মাগরীবের আজানের ধ্বনি শুনে সেলিম সমুদ্র পাড়ের মসজিদে গিয়ে নামায পড়ল। তারপর সে আবার বেলাভূমিতে ফিরে এসে ধীরে ধীরে সমুদ্রের পানির কিনার ধরে কিছুক্ষণ হাঁটার সময় হঠাৎ ভূত দেখার মতো সে চমকে উঠল। একটা বোরখা পরা মেয়ে মুখ খোলা অবস্থায় তার পাশ দিয়ে চলে গেল। সে দ্রুত ঘুরে বলল, এই যে শুনুন।
লাইলী প্রতিদিনকার মতো সূর্যাস্ত দেখে নামায পড়ে হোটেলে ফিরছিল। কতলোক সূর্যাস্ত দেখতে আসে। সেলিমকে সে দেখেনি, অন্য নোক ভেবে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল। প্রথমে সেলিমের গলার আওয়াজ পেয়ে সে স্তম্ভিত হয়ে গেল। পরে তার মনে হল কেউ হয়তো অন্য কাউকে ডাকছে। সে সেলিমের চিন্তায় ছিল বলে হয়তো তার গলার মতো শুনতে পেয়েছে। সেইজন্য থমকে দাঁড়িয়ে আবার পথ চলতে শুরু করল।
সেলিম ততক্ষণ লাইলীর সামনে এসে তার পথ রোধ করে দাঁড়াল। আবছা অন্ধকার হলেও দুজন দুজনকে চিনতে পারল। বেশ কিছুক্ষণ কেউ কোনো কথা বলতে পারল না। দুজনেরই মনে হল, স্বপ্ন দেখছে। চোখে পানি এসে গেছে বুঝতে পেরে লাইলী মাথা নিচু করে নিল।
সেলিম মৃদুস্বরে ডাকল, লাইলী?
লাইলী অশ্রুভরা নয়নে তার দিকে শুধু চেয়েই রইল। শত চেষ্টা করেও তার গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না, শুধু তার ঠোঁট দুটো নড়ে উঠল।
সেলিম বলল, তুমি আমার সঙ্গে কথাও বলবে না? জান, আমি ভালো হওয়ার পর থেকে তোমাকে পাগলের মত খুঁজে বেড়াচ্ছি? আর তুমি তোমার সেলিমকে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছ। তারপর তার হাত দুটো নিজের বুকে ধরে রেখে বলল, আল্লাহপাকের দরবারে কোটি কোটি শুকরিয়া জানাই, তিনি এত তাড়াতাড়ি আমার প্রিয়তমাকে পাইয়ে দিলেন।
লাইলী থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ে যাচ্ছিল।
সেলিম তাকে ধরে ফেলল। তারপর যখন বুঝতে পারল অজ্ঞান হয়ে গেছে, তখন তাকে পাজাকোলা করে পানির কাছে নিয়ে বসিয়ে একহাতে ধরে রেখে অন্য হাত দিয়ে চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিতে লাগল। বেশ কিছুক্ষণ কেটে যেতেও যখন তার জ্ঞান ফিরল না তখন তাকে আবার পাঁজাকোলা করে তুলে একটা বেবী ট্যাক্সিতে করে হোটেলের রুমে নিয়ে এসে বিছানায় শুইয়ে দিল। তারপর হোটেলের বয়কে দিয়ে ডাক্তার আনল।
ডাক্তার দেখে বললেন, ভয় পাবেন না, হঠাৎ মানষিক কারণে জ্ঞান হারিয়েছে। আমি একটা ইনজেকশন দিচ্ছি, এক্ষুণি জ্ঞান ফিরবে।
ডাক্তার ইনজেকশন দেওয়ার পাঁচ মিনিট পর লাইলীর জ্ঞান ফিরল। ঘরের চারিদিকে তাকিয়ে ধড়মড় করে উঠে বসে সেলিমের সঙ্গে ডাক্তারকে দেখে মাথার কাপড়টা টেনে দিয়ে মুখটা ঢেকে দিল। পানিতে বোরখা ভিজে গিয়েছিল বলে সেলিম রুমে এসে সেটা খুলে দিয়েছে।
ডাক্তার বললেন, আর কোনো চিন্তা নেই। সেলিম ডাক্তারকে বিদায় করে এসে দেখল, লাইলী জড়সড় হয়ে বসে আছে।
সেলিমকে ঘরে ঢুকতে দেখে সে খাট থেকে নেমে তার দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল।
সেলিম তার দিকে দু’হাত বাড়িয়ে ডাকল, ‘লাইলী।’
লাইলী আর স্থির থাকতে পারল না। সে ভুলে গেল এখনও তাদের বিয়ে হয়নি। সেলিম বলে ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে তার কাঁধে মাথা রেখে অশ্রু বিসর্জন করতে লাগল।
সেলিমেরও চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল। তারা স্থির হয়ে অনেকক্ষণ ঐভাবে রইল। কেউ কোনো কথা বলতে পারল না। যখন তাদের মনের উত্তাল স্পন্দন ক্লান্ত হল তখন প্রথমে লাইলী বুঝতে পারল তার চোখের পানিতে সেলিমের অনেকখানি জামা ভিজে গেছে। লজ্জা পেয়ে আলিঙ্গন মুক্ত হয়ে বলল, দেখ কি করলাম, তোমার জামা একদম ভিজিয়ে দিয়েছি।