বিমান যাত্রীদের মধ্যে একজন সুদর্শন যুবকের দিকে ম্যানেজার সাহেব হাত বাড়িয়ে বললেন, ঐ যে সাহেব আসছেন। ওরা প্রথমে তাকে ইউরোপিয়ান সাহেব মনে করে ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করল, আমাদের সাহেব কি ইংরেজ?
ম্যানেজার সাহেব বললেন, উনি খাস ঢাকাইয়া।
তখন সবাই অবাক হয়ে এগিয়ে যেতে লাগল। এত সুন্দর লোক তারা এর আগে দেখেনি।
অনেকগুলো লোকের সঙ্গে ম্যানেজার সাহেবকে এগিয়ে আসতে দেখে সেলিম আগে সালাম দিয়ে বলল, আশা করি, আল্লাহর রহমতে আপনারা ভালো আছেন।
ম্যানেজার ছাড়া আর কেউ সালামের জওয়াব দিতে পারল না। তারা অবাক হয়ে তাদের সাহেবের দিকে তাকিয়ে রইল। তাদের মধ্যে সুভাস নামে একটা ছেলে এগিয়ে গিয়ে সেলিমের গলায় ফুলের মালা পরিয়ে দিল এবং হাতে একটা লাল গোলাপ দিয়ে আদাব জানাল।
সেলিম খুশি হয়ে তাকে ধন্যবাদ দিল।
এদের সঙ্গে লাইলী আসেনি। সে সাহেবের আসবার খবরও জানে না। তার মায়ের শরীর দিন দিন ভেঙ্গে পড়ছে, তাই ডাক্তারের পরামর্শ মতো পনের দিনের ছুটি নিয়ে সাত দিন আগে মাকে নিয়ে কক্সবাজারে বেড়াতে গেছে। হামিদা বানুর দৈহিক কোনো অসুখ নেই। ডাক্তাররা বলছেন, উনি কোনো কারণে মনে ভীষণ আঘাত পেয়েছেন। সেই চিন্তাটা ওঁকে কুরে কুরে খাচ্ছে। লাইলী হোটেলে উঠেছে। লাইলী প্রতিদিন সূর্যাস্ত দেখতে সমুদ্র তীরে গিয়ে কিছুক্ষণ বেলাভূমিতে হাঁটে। তারপর পাড়ে বসে সূর্যাস্ত দেখে। সূর্যাস্তের পর ঐখানে মাগরিবের নামায পড়ে হোটেলে ফিরে আসে। প্রথম প্রথম মাকে সঙ্গে করে এনেছে। পরে উনি আসতে চান নাই, তাই লাইলী একাই রোজ আসে।
সেলিম অফিসে এসে সবকিছু দেখে বলল, আপনাদের ব্যবহারে আমি খুব আনন্দিত হয়েছি। আশা করি, আপনারা সব সময় সততার সঙ্গে কাজ করে এই ফার্মের উন্নতি করবেন। একটা কথা মনে রাখবেন, ফার্মের উন্নতী মানেই আপনাদের উন্নতি। আমি আর বেশি কিছু বলতে চাই না। এখন জলযোগ শেষ হওয়ার পর আজ ছুটি ঘোষণা করছি। আগামীকাল থেকে আপনারা যথারীতি কাজ করবেন। সকলে হাততালি দিয়ে উঠল।
সেলিম তাদের থামিয়ে দিয়ে বলল, হাততালি দেওয়া মুসলমানদের রীতি নয়। আনন্দ প্রকাশ করার সময় বলবেন, ‘সুবাহান আল্লাহ’ অথবা ‘মারহাবা মারহাবা।’ সাহেবের কথা শুনে সবাই অবাক হয়ে গেল। এ রকম কথা তারা কোনোদিন শুনে নাই। সবাইকে অবাক হতে দেখে সেলিম আবার বলল, আমি কোনো নূতন কথা আপনাদের বলিনি। পুরাতন কথাটা আপনারা জানেন না বলে নূতন বলে মনে হচ্ছে। তারপর ম্যানেজার সাহেবকে বললেন, কই খাবারের কি ব্যবস্থা করেছেন, এখানে আনতে বলুন, সকলে এক সঙ্গে বসে খাব।
অফিস স্টাফদের বিস্ময় ক্রমশঃ বেড়েই চলল। এতবড় ধনী মালিক, কর্মচারীদের সঙ্গে বন্ধুর মতো ব্যবহার করছেন। ম্যানেজার সাহেব বললেন, আপনারা অবাক হয়ে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছেন কেন? খাবারের ব্যবস্থা করুন। তারপর সকলে একসঙ্গে খাওয়ার পর অফিস ছুটি হয়ে গেল।
সেলিম পরের দিন জাষ্ট টাইমে অফিস কামরায় প্রবেশ করল। তারপর পিয়নকে ডেকে বলল, যারা এখানে কাজ করছে তাদের বায়োডাটা, ফটো ও দরখাস্তগুলো ম্যানেজার সাহেবকে নিয়ে আসতে বলুন।
ম্যানেজার সাহেব সবকিছু নিয়ে এলে তাকে বলল, আপনি এখন যান, প্রয়োজন হলে ডেকে পাঠাব। ম্যানেজার সাহেব চলে যাওয়ার পর তাদের কাগজ পত্রগুলো দেখতে লাগল। শেষ দরখাস্তের সাথে লাইলীর ফটো দেখে চমকে উঠল। সবকিছু ভুলে তন্ময় হয়ে ফটোর দিকে তাকিয়ে রইল। এক সময় তার চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল। কিছুক্ষণ পর তার কাগজ পত্রের উপর একবার চোখ বুলিয়ে বাথরুম থেকে চোখ মুখ ধুয়ে এসে ম্যানেজার সাহেবকে ডেকে পাঠাল।
ম্যানেজার সাহেব এসে সামনের চেয়ারে বসলেন।
সেলিম লাইলীর দরখাস্তটা এগিয়ে দিয়ে বলল, এই মেয়েটি দেখছি ষ্টেনোর জন্য দরখাস্ত করেছে। তাকে এপয়েন্টমেন্টও দিয়েছেন। কিন্তু কাল থেকে তাকে দেখছি না কেন?
ম্যানেজার সাহেব বললেন, এক সপ্তাহ আগে পনের দিনের ছুটি নিয়ে ডাক্তারের কথামতো তার অসুস্থ মাকে নিয়ে কক্সবাজারে বেড়াতে গেছে। লাইলীর মায়ের অসুখের কথা শুনে সেলিম খুব চিন্তিত হয়ে পড়ল।
সাহেবকে চিন্তিত দেখে ম্যানেজার সাহেব বললেন, মেয়েছেলেকে চাকরি দিয়েছি বলে কি তুমি অসন্তুষ্ট হয়েছ? সেলিম কিছু বলার আগে তিনি আবার বললেন, দেখ বাবা, আমার তো অনেক বয়স হয়েছে, এই মেয়েটির মতো আর দ্বিতীয় কোথাও দেখিনি। যেন সাক্ষাৎ বেহেস্তের হুর। মেয়েটিকে দেখে খুব দুঃখী বলে মনে হয়েছে এবং তার যে একটা চাকরির খুব দরকার সেটা বুঝতে পেরে দিয়েছি। অফিসে প্রতিদিন নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছে; কিন্তু আজ পর্যন্ত কেউ তার মুখ দেখেনি। আমাকে চাচা বলে ডাকে এবং আমিও তাকে মেয়ের মতো মনে করি বলে হয়তো সে আমার কাছে মুখ খুলে রাখে।
ম্যানেজার সাহেবের কথা শুনতে শুনতে সেলিম লাইলীর চিন্তায় ডুবে গেল। তার মন আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠল। কোনো রকমে সে ভাবটা গোপন করে বলল, ঠিক আছে, আপনি এখন আসুন। ম্যানেজার সাহেব চলে যেতে লাইলীর সব কাগজপত্র নিজের ব্রীফকেসে ভরে নিল। অফিস ছুটির পর সেলিম উপরে গিয়ে কিছুতেই নিজেকে বুঝাতে পারল না। তার মন এক্ষুণি কক্সবাজারে যাওয়ার জন্য ছটফট করতে লাগল। ছুটি শেষ হওয়ার পর লাইলীর ফিরে আসা পর্যন্ত ধৈৰ্য্য ধরে থাকা তার পক্ষে অসম্ভব বলে মনে হল। শেষে অনেক ভেবেচিন্তে ম্যানেজারকে চিঠি লিখল।