রাত্রি আটটায় সেলিম ঘরে ফিরল। তাকে দেখতে পেয়ে আরিফ সালাম দিয়ে প্রায় ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে বলল, ভাইয়া তুমি কেমন আছ?
সেলিম সালামের উত্তর দিয়ে ছোট ভাইকে আবেগের সঙ্গে বুকে চেপে ধরল। তারপর কান্নাজড়িত স্বরে বলল, মাঝে মাঝে চিঠি দিয়ে আমাদের অশান্তি দূর করতে পারতিস। তোর ঠিকানা জানা থাকলে আর কথা জানাতে পারতাম। তারপর দুভাই দুজনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। এশার আজান শুনে সেলিম বলল, চল মসজিদ থেকে নামায পড়ে আসি।
আরিফ সেলিমকে আবার জড়িয়ে ধরে বলল, তুমি নামায পড়? ইয়া আল্লাহ তোমার দরবারে জানাই লাখ লাখ শুকরিয়া।
সেলিম আস্তে আস্তে ভিজে গলায় বলল, তোকে এক সময় সব কথা বলব। এখন শুধু এইটুকু জেনে রাখ, যে আমাকে এই পথে চালিত করল, তাকে ভাগ্যদোষে হারিয়ে ফেলেছি।
নামায পড়ে এসে সকলে মিলে গল্প করতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যে সোহানা বেগম খাওয়ার জন্য সবাইকে ডেকে পাঠালেন।
ডাইনিংরুমে গিয়ে আরিফ বলল, ভাইয়া, চেয়ার টেবিলে বসে খাওয়া আর চলবে না।
সেলিম বলল কেন? হাদিসে এরকম কিছু লেখা আছে নাকি? না এটা তোর গোঁড়ামী?
আরিফ বলল, আমার গোঁড়ামী কি না জানি না, আর হাদিসেও তা লেখা নেই। তবে রাসূলুল্লাহ (সঃ) ফ্লোরে বসে দস্তরখানা বিছিয়ে খেতেন। হাদিসে আছে, তিনি বলেছেন, “যে দস্তরখানা বিছিয়ে খাবে এবং তাতে যা খাবার পড়বে তা কুড়িয়েও খাবে, সে কোনোদিন অভাবগ্রস্ত হবে না। আর যারা খাবার জিনিষ যদি চারিদিকে ফেলে খায়, তা হলে ঐ ফেলে রাখা খাবারগুলো তাদের জন্য অভিসম্পাৎ করে।“(১) তা ছাড়া এটা বিধর্মীদের অনুকরণ করা হয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ (সঃ) আরো বলেছেন “যারা যে ধর্মাবলম্বীদের অনুকরণ করবে অর্থাৎ তাদের যে কোনো কাজ পছন্দ করবে, তারা কেয়ামতের দিন তাদের সঙ্গে উঠবে।”(২) এখন তুমিই বল, আমরা রাসূলুল্লাহ (সঃ) কে অনুকরণ করব না বিধর্মীদের অনুকরণ করব?
সেলিম বলল, ঠিক আছে আজ খেয়ে নে, পরে যে যার ইচ্ছামত করবে। না তুই মেঝেয় বসেই খাবি?
আরিফ বলল, টেবিল চেয়ারে বসে খাব না কেন? এতে খেলে তো আর গোনাহ হচ্ছে না। তবে এটা সুন্নতের বরখেলাপ, পরিত্যাগ করা উচিৎ।
খেতে খেতে সেলিম আসমাকে দেখিয়ে আরিফকে জিজ্ঞেস করল, একে চিনিস? এ বড় বিপন্না মেয়ে। নাম অসমা। ওর একটা ফুটফুটে ছেলে আছে। আমি একে ছোট বোন বলে গ্রহণ করেছি। আশা করি, তুইও ওকে ছোট বোনের মত গ্রহণ করবি।
আরিফ বলল, আল্লাহপাক তা হলে আমাদেরকে আর একটা বোন দিয়েছেন? খাওয়ার পর্ব শেষ করে সকলে বারান্দায় বসে আরিফের বিদেশে কাটান দিনগুলোর কথা শুনতে লাগল। সোহানা বেগম একবার ঘুমাবার জন্য তাড়া দিয়ে গেলেন। আসমা তার বাচ্চাকে নিয়ে ঘুমাতে গেল। একটু পরে রুবীনা ঘুম পাচ্ছে বলে উঠে গেল। আরিফ বলল, ভাইয়া, তোমার উপর আমার যেন কেমন সন্দেহ হচ্ছে।
কি রকম সন্দেহ?
মনে হচ্ছে কোনো মায়বীনি তোমাকে তার মায়ায় ফেলেছে। তুমি সেই মায়ার যাদুতে হাবুডুবু খাচ্ছ। শত চেষ্টা করেও নাগাল পাচ্ছ না।
সেলিম তার মুখের দিকে হা করে চেয়ে রইল, কিছুই বলতে পারল না।
কি হল ভাইয়া, তুমি কথা বলছ না কেন? তুমি নারীর প্রেমে পড়েছ বলেছি বলে আমাকে খুব অসভ্য, বেহায়া মনে করছ বুঝি?
সেলিম সামলে নিয়ে বলল, সেটা ভাবা কি আমার অন্যায় হবে?
তা হবে না বলে আরিফ চুপ করে গেল।
সেলিম করুণ স্বরে বলল, তোর সন্দেহটা ঠিক। সত্যিই আমি লাইলী নামে একটা মেয়েকে ভালবেসেছি। কিন্তু ললাট লিখন কে খণ্ডাবে বল। কপালের ফেরে দুজনেই বিরহ জালায় জ্বলছি। আল্লাহই জানেন আমাদের কি হবে।
তুমি কি বলছ ভাইয়া আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।
সেলিম খুব সংক্ষেপে ওদের দুজনের ঘটনা বলল। তারপর একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তুই এবার ঢাকার সব কিছু দেখাশোনা কর। আমি চিটাগাং-এরটা দেখব। শুনেছি, লাইলী সেখানেই আছে? চেষ্টা করব তাকে খুঁজে বের করার। বাকি আল্লাহপাকের মর্জি।
———-
(১) বুস্তানুল আরেফিন ৯১ পৃঃ।
(২) বর্ণনায় ও হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ)-আহাম্মদ, আবু দাউদ।
০৯. সেলিম আরিফকে নিয়ে
সেলিম আরিফকে নিয়ে মিল, কারখানা ও অফিসের সকলের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। সব কাজ তাকে বুঝিয়ে দিতে লাগল। সারাদিন কাজের মধ্যে ডুবে থাকলেও রাত্রে ঘুমোবার সময় লাইলীর চিন্তায় সে অস্থির হয়ে উঠে। সবকিছু তার কাছে অসহ্য মনে হয়। শেষে একদিন সবাইকে জানিয়ে দিল, আগামীকাল সে। চিটাগাং যাবে।
সোহানা বেগম বললেন, আর কয়েকদিন থেকে যা।
সেলিম বলল, ম্যানেজার ট্রাঙ্কল করেছিল, আমার যাওয়া একান্ত প্রয়োজন নচেৎ অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। কালকের ফ্লাইটে যাব বলে ম্যানেজারকে বলে দিয়েছি। পরের দিন সেলিম দশটা চল্লিশের প্লেনে চেপে বসল।
এদিকে ম্যানেজার সাহেব অফিসের সমস্ত ষ্টাফকে জানিয়ে দিয়েছেন, সাহেব আসছেন। অফিসের কেউ এখনও তাদের সাহেবকে দেখেনি। ম্যানেজার সাহেবের কাছেই তারা শুনেছে, সাহেবের মতো সাহেব নাকি আর হয় না। তিনি সততাকে খুব ভালবাসেন। যারা সততার সঙ্গে কাজ করে তারা তার প্রিয়পাত্র। সকলে মিলে সাহেবকে অভ্যর্থনা করার ব্যবস্থা করল। তারা জেনে ছিল, এই অফিস উদ্বোধন করার পরের দিন তিনি এ্যাকসিডেন্ট করেন এবং চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশ নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তারা সমস্ত অফিস কক্ষ রংবেরং এর রঙিন কাগজ দিয়ে সাজাল। সাহেবের অফিস রুমটা সব থেকে আকর্ষণীয় করে তুলল। তারপর রিসিভ করার জন্য সবাই এয়ারপোর্ট গেল।