লোকটির নাম মৌলবী আজহার উদ্দিন। উনি ঐ এলাকার খুব নামী লোক। অবস্থাও খুব ভাল। নিজেদের একটা মাদ্রাসা আছে। এখানে ছেলেরা প্রথমে শুধু হাফেজী পড়ে। তারপর বড় মাদ্রাসায় ভর্তি হয়। সেখান থেকে পাশ করলে আরবীতে এম, এম এবং ইংরেজীতে বি. এ. সার্টিফিকেট দেওয়া হয়। তিনি আরিফকে নিজের বাড়িতে সঙ্গে করে যখন পৌঁছালেন তখন দুপুর বারটা।
দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পর যোহরের নামায পড়ে আরিফ বিশ্রাম নিচ্ছিল। এমন সময় মৌলবী সাহেব ছোট দুটি ছেলে-মেয়ে সঙ্গে করে এনে পরিচয় করিয়ে দিয়ে তাদেরকে বললেন, ইনি তোমাদের মাষ্টার। আজ থেকে তোমরা ইনার কাছে পড়বে। তারপর আরিফকে বললেন, তোমার যদি আপত্তি না থাকে, তবে তুমি এখানে ছেলের মতো থেকে পড়াশোনা করতে পার। আমি তোমার পড়াশোনার সব ব্যবস্থা করে দেব।
আরিফ এতটা আশা করেনি। সে বিদেশে কোথায় কিভাবে থাকবে, কি পড়বে এতক্ষণ সেইসব চিন্তা করছিল। এত তাড়াতাড়ি তার ব্যবস্থা হয়ে গেল দেখৈ মনে মনে আল্লাহপাকের দরবারে শোেকরগুজারী করল। বলল, দেখুন চাচাজান, আপনার ঋণ আমি কোনোদিন শোধ করতে পারব না। আপনি আমার জন্য যা করছেন, তা আমি ভাবতেও পারছি না। দোয়া করুন, আল্লাহপাক যেন আমার মনের বাসনা পুরণ করেন।
কি যে বল বাবা, আমি আর কতটুকু তোমার জন্য করেছি। নিজের জন্মভূমি ছেড়ে বিদেশে ধর্মের জ্ঞানলাভ করতে এসেছি। তুমি অতি ভাগ্যবান। যারা এই রাস্তায় ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে, আল্লাহপাক তাদের সহায় হন। আর আমি তার একজন নগণ্য বান্দা হয়ে যদি তোমাকে সাহায্য না করি, তবে তিনি নারাজ হবেন। প্রত্যেক লোকের মানষিক উদ্দেশ্য থাকা উচিত, আল্লাহপাক কিসে সন্তুষ্ট হন। আমি ঘরের ছেলের মতো থেকে পড়াশোনা কর। আর এদেরকে নিজের ভাইবোন মনে করবে। কোনো কিছু অসুবিধা হলে জানাবে। আমি যথাসাধ্য দূর করার চেষ্টা করব।
সেই থেকে আরিফ ওখানে থেকে পড়াশুনা করতে লাগল। সে জানাল, প্রথমে হাফেজী পড়বে। তারপর উচ্চশিক্ষার জন্য বড় মাদ্রাসায় ভর্তি হবে। মৌলবী সাহেব তাকে সেইমত ব্যবস্থা করে দিলেন। এখানে এসে আরিফ যেন তার চিরআকাঙ্খিত ধন খুঁজে পেল। এখানকার ছেলে-মেয়েদের ও লোকজনের আচার-ব্যবহার, পোশাকপরিচ্ছদ সব ইসলামী ছাঁচে। এখানে যেন বিধর্মী ইহুদী, খৃষ্টানদের সভ্যতা প্রবেশ করেনি। সে খুব মন দিয়ে লেখাপড়া করতে লাগল। নিয়মিত নামায পড়ে আল্লাহ পাকের দরবারে মোনাজাত করতে লাগল—
‘হে রাব্বুল আল-আমিন, তুমি সমগ্র মাখলুকাতের সৃষ্টিকর্তা। তুমি আলেমুল গায়েব। তোমার অগোচর কিছুই নেই। তুমি সর্বশক্তিমান। তোমার প্রশংসা করা আমার মত ক্ষুদ্ৰ জীবের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে আমি শ্ৰেষ্ঠ সৃষ্টির একজন নগণ্য বান্দা। তোমার দরবারে কোটি কোটি শুকরিয়া আদায় করে এই নিবেদন করছি, তমি আমার সমস্ত অপরাধ মাফ করে দাও । আমাকে ইসলামের একজন খাদেম তৈরি করে ধন্য করো। আমি সব কাজ যেন তোমাকে খুশি করার জন্য করি। তোমার প্রিয় বান্দারা যে রাস্তায় গমন করেছেন, আমাকেও সেই পথে চালিত কর। আর আমি বাবা-মার মনে যে কষ্ট দিয়ে এসেছি, তাদের সেই কষ্ট দূর করার তওফিক আমাকে দান কর। আমার দিকে তোমার রহমতের দৃষ্টি দান করা। তোমার প্রিয় হাবিব ও রাসূল (দঃ) যে পথ দেখিয়ে দিয়ে গেছেন, সেপথে আমাকে দৃঢ় সেই হাবিবের (দঃ) উপর হাজার হাজার দরূদ ও সালাম। তোমার রাসূলে পাক (দঃ)এর অসিলায় আমার দোয়া কবুল করো। আমিন।
প্রতিদিন তাহাজ্জুদ নামাযের পরও আরিফ কেঁদে কেঁদে উক্ত দোওয়া লাগল। সে জেনেছিল, বান্দা যদি চোখের পানি ফেলে আল্লাহ পাকের দরবারে ফরিয়াদ করে, তবে তা তিনি কবুল না করে থাকতে পারেন না। রাসূল হাদিসে বলিয়াছেন—‘আল্লাহ পাকের নিকট সর্বোৎকৃষ্ট ও অতি প্রিয় জিনিস মোমেন বান্দার চোখের পানি। সেই পানি গাল বেয়ে পড়ার আগেই তার দোয়া করে নেন। মোমেন বান্দার চোখের পানি আল্লাহ পাকের আরাশকে কাঁপিয়ে তাই তিনি বান্দার দোয়া কবুল করেন।’
০২. লাইলী ক্লাসে ঢুকে দরজার কাছে
লাইলী ক্লাসে ঢুকে দরজার কাছে সীট ফাঁকা পেয়ে বসে পড়ল। প্রফেসার তখন লেকচার দিচ্ছিলেন। শতচেষ্টা করেও মনোযোগ দিতে পারল না। কেবলই সেলিমের সঙ্গে ধাক্কা খাওয়া থেকে শেষ পর্যন্ত ঘটনাগুলো তার মনে ভেসে উঠতে লাগল। ক্লাস যে কখন শেষ হয়ে গেছে টের পেল না। ছেলে মেয়েরা সব বেরিয়ে গেল।
বান্ধবী সুলতানা তাকে বসে থাকতে দেখে বলল, কিরে যাবি না? বসে আছিস কেন? শরীর খারাপ না কি?
চমকে উঠে সম্বিত ফিরে পেয়ে লাইলী বলল, নারে, শরীর ভালো আছে, তবে বলে থেমে গেল।
সুলতানা বলল, তবে কিরে? কিছু হয়েছে নাকি বল না?
না কিছু হয়নি বলে বই নিয়ে এক সঙ্গে ক্লাস থেকে বেরিয়ে এল। ঘরে ফিরার সময়ও লাইলী খুব অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল। কখন বাসায় পৌঁছে গেছে জানতে পারেনি। রিকশাওয়ালার ডাকে খেয়াল হতে চিন্তিত মনে বাড়িতে ঢুকল।
লাইলীদের বাড়ি র্যাকিন ষ্ট্রীটে। তার আহ্বার নাম আঃ রহমান। উনি সোনালী ব্যাংকের একজন সামান্য কেরানী। আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো নয়। ওঁর এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলেটা বড় ছিল। বছর দুয়েক আগে বি, এ, পরীক্ষার রেজাল্ট নিয়ে ফেরার পথে গুলিস্তানের মোড়ে রাস্তা পার হওয়ার সময় লরী চাপা পড়ে মারা যায়। লাইলী তখন ক্লাস টেনে পড়ে। ভাইয়ের চেয়ে লাইলী ব্রেনী। সে প্রতি বছর ফাস্ট হয়। একমাত্র ছেলের মৃত্যুর পর রহমান সাহেব খুব মুষড়ে পড়েন। তারপর মেয়ে যখন স্কলারসিপ নিয়ে ম্যাট্রিক পাশ করে কলেজে পড়তে চাইল তখন তিনি প্রথমে মোটেই রাজি হন নি। শেষে মেয়ের কান্নাকাটি সহ্য করতে না পেরে শত অভাবের মধ্যে কলেজে ভর্তি করেন। আর মাসোহারা দিয়ে একটি রিকশা ঠিক করে দিলেন লাইলীকে কলেজে নিয়ে যাবে-আসবে বলে।