কে অনুরোধ করল। লাইলী কিছুতেই সম্মত হল না। শেষে সবই সেলিমকে বলল, তোমাকে কিছু শোনাতে হবে। সেলিম সে জন্য প্রস্তুত ছিল। সে স্বরচিত একটা গান অন্তরের সমস্ত দরদ দিয়ে গাইল–
তুমি সুন্দর তাইতো শুধু তোমার পানে চেয়ে থাকি,
তোমার নয়ন মনিতে দেখিতে পাই নিজের প্রতিচ্ছবি।
আমার হৃদয়ে তোমার স্মৃতি রয়েছে যে গো জড়িয়ে,
তাইতো তোমায় পুলকিত মনে চেয়ে দেখি বারে বারে।
লোকলজ্জা বাধা দিতে পারে নাকো হেন কাজে,
আমি যে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি তোমারই মাঝে।
পৃথিবীতে যা কিছু সুন্দর,
সবারই কাছে হয় তা সমাদর।
কাউকে যদি সেই সুন্দর করে আকর্ষণ,
তা হলে কি তারে দুষিবারে পারে সর্বজন?
যে যাই বলুক, মাশুক করে না কো দুর্ণামের ভয়,
শত বাধা ঠেলে সে তার সুন্দরকে পেতে চায়।
পৃথিবীতে এমন কত আশেক মাশুক আছে,
বাধা পেয়ে গেছে হারিয়ে নিষ্ঠুর সমাজের কাছে।
তাই মনে হয় মানুষ যদি মানুষের মত হত,
তা হলে তারা সুন্দরের মর্যাদা দিতে জানত।
সেলিম যখন গান গাইতে শুরু করে, তখন রেহানার ভাই মনিরুল এল। সেলিমের দৃষ্টি অনুসরণ করে সে লাইলীকে দেখে একেবারে এসটোনিষ্ট হয়ে গেল। অন্য সব মেয়েদের দিকে চেয়ে আবার লাইলীর উপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চিন্তা করল, ওরা সব দামী দামী কাপড় পরে কত রকমের প্রসাধন মেখে সুন্দরী সেজেছে। আর লাইলীকে প্রসাধনহীন সাধারণ পোষাকে তাদের থেকে অনেক বেশি সুন্দরী দেখাচ্ছে। গানটা শুনে মনে মনে সেলিমকে ধন্যবাদ না দিয়ে পারল না। সত্যি এরকম নিখুঁত সুন্দরী মেয়ে পৃথিবীতে বিরল। সে লাইলীর দিকে একাগ্রচিত্তে চেয়ে রইল।
গান শেষ হওয়ার পর হাত তালিতে ঘর ভরে উঠল। সবশেষে সোহানা বেগম সকলকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আজকের এই অনুষ্ঠানে আপনাদেরকে একটা আনন্দের খবর জানাচ্ছি। তারপর লাইলীর কাছে গিয়ে তাকে দাঁড় করিয়ে বললেন, এই যে মেয়েটিকে আপনারা দেখছেন, অনেকে একে চেনেন না। এ একজন সাধারণ ঘরের মেয়ে, ইসলামীকে হিষ্ট্ৰীতে অনার্স পরীক্ষা দিয়েছে। এর নাম লাইলী। একে সেলিম পছন্দ করেছে বিয়ে করার জন্য। আমিও ছেলের পছন্দকে সমর্থন করি। আশা করি, আপনারাও সেলিমের পছন্দ করা মেয়েকে সমর্থন করবেন। কথা শেষ করে তিনি দু’গাছা সোনার বালা লাইলীর হাতে পরিয়ে দিয়ে সকলকে দোয়া করতে বললেন।
লাইলী ভীষণ লজ্জা পেয়ে মাথা হেঁট করে রইল। আর সবাই হাততালি দিয়ে আনন্দ প্রকাশ করতে লাগল। অনেকে বলল, সেলিমের পছন্দকে বাহবা দিতে হয়। সেলিম খুব সুন্দর। তার বৌ তার থেকে আরও বেশি সুন্দরী। যারা এর আগে লাইলীকে দেখেনি, তারা তার রূপ দেখে নির্বাক হয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
তারপর ডিনার পরিবেশন করা হল। বাইরের মেহমানরা বিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার পর সোহানা বেগম দাদাকে ডেকে বললেন, রেহানাকে বৌ করব বলে মনে বড় সখ ছিল। সেইজন্য একদিন তোমাকে সেকথা বলেও ছিলাম। কিন্তু সেলিমকে কিছুতেই রাজি করাতে পারিনি। আমি তোমার ছোট বোন হয়ে আমার অপরাধের জন্য মাফ চাইছি। তুমি আমাকে মাফ করে দাও দাদা।
রেহানার বাবা জাহিদ সাহেব বললেন, এতে তোমার কোনো অপরাধ হয়নি। আজকাল শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা নিজেদের পছন্দ মত বিয়ে করে। তাই সেলিমকেও দোষ দেওয়া যায় না। তবে মেয়েটির বাবা কি করেন? তাদের বংশ কেমন? দেখা দরকার। তারপর তিনি ছেলেমেয়েকে সঙ্গে করে বাড়ি ফিরে গেলেন।
সোহানা বেগম লাইলীকে খাইয়ে দিয়ে সেলিমকে বললেন, ওকে এবার বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আয়। আর লাইলীকে বললেন, তোমার বাবা মাকে আমার সালাম জানিয়ে বলে, আমি দুই একদিনের মধ্যে আসছি।
লাইলী সোহানা বেগমকে কদমবুছি করলে তিনি লাইলীর মুখে চুমো খেয়ে বললেন, সুখী ও দীর্ঘজীবি হও মা।
লাইলী সেলিমের পাশে বসেছে। সেলিম ধীরে ধীরে গাড়ি চালাতে চালাতে জিজ্ঞেস করল, সেলিম নামে দুষ্ট ছেলেটার সাথে বিয়েতে মত আছে তো? তোমার কোনো মতামত না নিয়েই তার মা তোমার সঙ্গে ছেলের বিয়ের কথা সবাইকে জানিয়ে দিলেন।
এমনিতেই লাইলী খুব লজ্জিত ছিল। তার উপর সেলিমের প্রশ্ন শুনে আরও বেশি লজ্জা পেয়ে কথা বলতে পারল না। কারণ আনন্দ আর লজ্জা তখন গলা টিপে ধরেছে।
তাকে চুপ করে থাকতে দেখে সেলিম আবার জিজ্ঞেস করল, আমার প্রশ্নে উত্তর দিলে না যে?
লাইলী সেলিমের কাঁধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে আস্তে আস্তে বলল, আমি তো অনেক আগেই সেই দুষ্ট ছেলেটার পায়ে নিজেকে সঁপে দিয়েছি। আবার ঐ সব প্রশ্ন করছ কেন? আমার ভীষণ লজ্জা করছে।
সেলিম ডান হাত দিয়ে তার গলাটা আলতো করে টিপে দিয়ে বলল, লজ্জা মেয়েদের চিরচারিত ভূষণ। যে মেয়ের লজ্জা নেই, তাকে সেলিম পছন্দ করবে কেন?
সেলিমের হাতের স্পর্শ পেয়ে লাইলী কারেন্ট সর্ট খাওয়ার মত কেঁপে উঠে ঐ অবস্থায় নিথর হয়ে বসে রইল।
লাইলীদের বাড়ির গেটে গাড়ি পার্ক করে সেলিম বলল, আবার কবে তোমাকে দেখতে পাব?
লাইলী গাড়ি থেকে নেমে কলিং বেলে হাত রেখে বলল, যে দিন তুমি ইচ্ছা করবে।
জলিল সাহেব অফিস থেকে ফিরে সকালের দিকের ঘটনা শুনেছেন। তিনি গেট খুলে ওদের দুজনকে দেখতে পেলেন। সেলিমকে সালাম দিয়ে বললেন, কেমন আছেন?
সেলিম সালামের উত্তর দিয়ে বলল, ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?