লাইলী বলল, এইতো একটু আগে এসেছি। আমি ভালো আছি, আপনি কেমন আছেন।
আল্লাহপাকের রহমতে খুব ভালো আছি ভাই। আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব, কিছু মনে করবেন না তো?
না, কি বলবেন বলুন।
আপনি কি এদের আত্মীয়া?
না, এরপরে যে প্রশ্ন করবেন, সেটার উত্তর সেলিম সাহেবের কাছ থেকে জেনে নেবেন।
আসমা বলল, সত্যি আল্লাহপাক আপনাকে যেমন রূপবতী করেছেন তেমনি বুদ্ধিমতীও করেছেন বলে হেসে ফেলল।
আপনার ছেলেকে দেখছি না যে, তার কি নাম রেখেছেন?
সে আয়ার সঙ্গে বাগানে বেড়াচ্ছে। দাদাই তার নাম রেখেছে রফিকুল ইসলাম।
মায়ের সাথে সেলিম এঘরে এসে লাইলীর সঙ্গে আসমাকে কথা বলতে দেখে জিজ্ঞেস করল, একে চিনতে পেরেছিস?
আসমা বলল, হ্যাঁ, তুমি যেদিন আমাকে নিয়ে এলে সেদিন তো ইনিই তোমার সঙ্গে ছিলেন। আচ্ছা দাদা, ইনি আমাদের কে হন? তুমি তো আজও পরিচয় করিয়ে দিলে না?
সেলিম বলল, কেন? তুই পরিচয় জেনে নিতে পারিস না।
চেষ্টা তো করেছিলাম, প্রথম চালেই ফেল করেছি।
ফেল যখন করেছিস তখন মায়ের কাছ থেকে জেনে নিস।
সোহানা বেগম বললেন, একটু পরেই সবাই ওর পরিচয় জানতে পারবে। তারপর ওদেরকে এদিকের কাজ দেখতে বলে সেলিমকে সঙ্গে করে মিটিং রুমে এসে প্রবেশ করলেন।
সেলিম ঢুকেই “আসসালামু আলাইকুম” দিয়ে বলল, আমার আসতে একটু লেট হয়ে গেছে, সেই জন্য প্রথমে আপনাদের কাছে মাফ চাইছি।
মাতা পুত্রকে এক সঙ্গে আসতে দেখে সবাই দাঁড়িয়ে পড়ল। তাদের মধ্যে দু’একজন সালামের উত্তর দিল।
সেলিম তাদের সবাইকে বসতে অনুরোধ করে বলল, আজকে আমরা শ্রমিকদের বোনাস, বেতন ও তাদের সুবিধা অসুবিধার ব্যাপারে আলোচনা করব। আপনারা সব প্রবীন ব্যক্তি। অনেকদিন থেকে বিশ্বস্ততার সঙ্গে কাজ করে আসছেন। আমি যা কিছু বলব, তার মধ্যে ভুলত্রুটি হলে সুধরে দেবেন এবং প্রত্যেকে নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করবেন। তারপর কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থেকে সেলিম আবার বলতে শুরু করল, আপনাদের ন্যায়নিষ্ঠ ও পরিশ্রমের ফলে আমাদের দিন দিন উন্নতি হচ্ছে। অবশ্য এতে শ্রমিকদেরও দান রয়েছে। আমার মতে একজন কুলি থেকে আমরা যারা এখানে রয়েছি, সবাই শ্রমিক। শুধু আমাদের কাজ ভিন্ন। যাই হোক, আমি যা বলছিলাম, আমরা মানে মিল-কারখানার সমস্ত অফিসার ও শ্রমিকরা দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করেছি বলে অন্যান্য বছরের চেয়ে এবছর দ্বিগুণ মুনাফা হয়েছে। আমি এই অধিক মুনাফা থেকে দুমাসের বেতন ঈদের বোনাস হিসাবে এবং গ্রেড অনুযায়ী প্রত্যেকের বেতন বাড়িয়ে দিতে চাই। আর শ্রমিকদের ফ্রি চিকিৎসার জন্য মিল এলাকায় একটা হাসপাতাল করার মনস্থ করেছি। এখন আপনারা প্রত্যেকে নিজের মতামত প্রকাশ করে ঠিক করুন, কতটা কি করা যায়।
সেলিম থেমে যেতে সকলে মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগলেন। সোহানা বেগম প্রথমে বলে উঠলেন, প্রত্যেককে দুই মাসের বেতন বোনাস দিলে কত টাকা লাগবে তা হিসেব করে দেখেছ?
সেলিম মায়ের দিকে চেয়ে বলল, যা লাভ হয়েছে তার একের আট অংশ।
সোহানা বেগম বললেন, আমি এতে রাজি। এবার আপনাদের মতামত বলুন।
ডাইরেক্টর আসাদ সাহেব বললেন, আপনারা মালিক হয়ে যখন খুশি মনে এসব দিচ্ছেন তখন আমরা তাতে অমত করব কেন?
জেনারেল ম্যানেজার বসির সাহেব বললেন, কিন্তু যে বছর লোকসান যাবে, সে বছরের কথা চিন্তা করেছেন। তখন কত টাকা আসল থেকে বেরিয়ে যাবে?
সেলিম বলল, আপনি ঠিক বলেছেন। আমি সে কথাও চিন্তা করে দেখেছি। লাভ-ক্ষতি নিয়ে ব্যবসা। কোনো বছর লাভ হবে। আবার কোনো বছর ক্ষতি হবে। আপনারা তা এত বছর কাজ করে আসছেন, কোনো বছর ক্ষতি হয়েছে কি? হয় নি? তবে লাভ কম বেশি হয়েছে। তা ছাড়া আল্লাহর প্রেরিত রাসূল (দঃ) বলেছেন। “যে ব্যবসায় ক্ষতি ছাড়া শুধু লাভ হয়, সে ব্যবসা হারাম। যেমন সুদের ব্যবসা। এই ব্যবসায় লাভ ছাড়া ক্ষতি নাই। তাই এটা হারাম।” আমি মনে করি, শ্রমিকদের খুশি রাখলে তারা আরও দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে কাজ করবে। আমরা যদি তাদের সব রকম সুবিধা অসুবিধার দিকে লক্ষ্য রাখি, আর তাদের উপযুক্ত পারিশ্রমিক দিই, আমার দৃঢ় ধারণা, তা হলে তারা কোনো দিন কাজে ফাঁকি দেবে না। বেশি পাওয়ার আশায় আরো বেশি পরিশ্রম করবে।
ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার আসিফ সাহেব প্রবীণ ও ধার্মিক ব্যক্তি। তিনি বললেন, আল্লাহপাক আপনাকে কামিয়াব করুন। আপনার কথা আমার খুব পছন্দ হয়েছে। আশা করি, আমার অন্যান্য সহকর্মী ভাইয়েরাও আপনাকে সমর্থন করবেন। ওঁর কথা শেষ হওয়ার পর সকলে সেলিমকে সমর্থন করলেন। তারপর সকলে মিলে আলোচনা করে মুসলমান অফিসার ও শ্রমিকদের জন্য দুই ঈদে দু’মাসের বেতন এবং হিন্দুদের জন্য পূজার সময় দু’মাসের বেতন বোনাস ও গ্রেড অনুযায়ী বেতন বাড়ানর
এবং মিল এলাকায় আপাতত পঁচিশ বেডের একটা হাসপাতাল করার সিদ্ধান্ত নিল।
মাগরিবের নামাযের সময় হয়ে গিয়েছিল। সভা শেষ ঘোষণা করে সেলিম নামায পড়ার জন্য মসজিদে গেল। মেম্বারদের মধ্যেও দুজন গেলেন।
সন্ধ্যার পর নিমন্ত্রিত মেহমানরা আসতে লাগল। রেহানাও তার মার সঙ্গে এসেছে। সেলিমের অনেক বন্ধু বান্ধবী এল। তারপর ছোট খাট গানের আসর হল। যারা সেবারে লাইলীর গজল শুনেছিল, তারা আজও একটা গজল গাওয়ার জন্য