কয়েক সেকেণ্ড মাথা নিচু করে থেকে যখন লাইলী তার হরিণীর মত চোখ নিয়ে সেলিমের দিকে তাকাল তখন তার চোখ থেকে টপ টপ করে পানি পড়ছে।
সেলিম তাকে কাঁদতে দেখে একটু ঘাবড়ে গিয়ে বলল, আমি তো একটু রসিকতা করলাম। এতে তুমি কাঁদবে জানলে বলতাম না। ঠিক আছে, আমি আমার কথা উইথড্র করে নিচ্ছি। প্রীজ চোখ মুছে ফেল।
লাইলী আঁচলে চোখ মুছে বলল, এই হতভাগীকে যে তুমি অত ভালবাস, সেটা কি আমার কপালে সইবে?
রহিমা চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে ঘরে ঢুকে লাইলীর কথা শুনে বলল, আরে ভাই কপালে কি লেখা আছে না আছে, তা যিনি লিখেছেন তিনিই জানেন। ওসব নিয়ে অত চিন্তা করে কাজ নেই। মানুষ বর্তমানকে নিয়ে বেঁচে থাকে। প্রত্যেক মানুষের উচিত তাঁর উপর নির্ভর করে যখন যে অবস্থায় তিনি রাখেন, তাতেই সন্তুষ্ট থাকা। তাই দুঃখ হোক আর সুখ হোক। সেটা তাঁরই নির্দেশ বুঝেছ? নাও, এখন চিন্তা বাদ দিয়ে চা খেয়ে দুজনে একটু বেড়িয়ে এস।
লাইলী লজ্জারাঙা চোখে ভাবির দিকে চেয়ে বলল, আম্মাকে কি বলে যাব?
সে চিন্তাও বাদ দাও, আমি খালা আম্মাকে বলবখন।
বারে, আম্মাকে বলে যেতে হবে না?
বেশতো বলেই যাও।
কি বলে যাব?
যা সত্য তাই বলবে, তুমি তো মিথ্যা বলবে না। সত্য পথে চললে বাধা বিঘ্ন তো আসবেই। তুমি বলত ভাই, ঠিক বলছি কিনা বলে রহিমা সেলিমের দিকে চাইল।
সেলিম কোনো কথা না বলে মিটি মিটি হাসতে লাগল।
লাইলী চা খেয়ে কাপটা টেবিলের উপর নামিয়ে রেখে এক্ষুণি আসছি বলে উপরে চলে গেল।
রহিমা চায়ের কাপ ও পিরীচগুলো নিয়ে যাওয়ার সময় বলল, আমার সখীর জন্য একা একা একটু অপেক্ষা কর ভাই।
লাইলী একটা গ্রীন রং-এর শাড়ী ও ব্লাউজ পরে তার উপর বোরখা চড়িয়ে রহমান সাহেবের কাছে গিয়ে বলল, আব্বা, আমি একটু বাইরে যাচ্ছি।
রহমান সাহেবের হার্টের অসুখটা ক’দিন থেকে বেড়েছে। তিনি এই ক’দিন অফিসে যেতে পারেননি, শুয়েছিলেন। বললেন, তাড়াতাড়ি ফিরে আসবি।
স্ত্রী হামিদা বানু স্বামীর পাশে বশে বুকে তেল মালিশ করছিলেন। লাইলী বেরিয়ে যাওয়ার পর বললেন, মেয়ে কোথায় কার সাথে গেল, জিজ্ঞেস করলে না যে?
রহমান সাহেব বললেন, ছেলেমানুষ পরীক্ষার পর একটু কোথাও বেড়াতে যাবে হয়তো, তাতে অত দোষ মনে করছ কেন?
মেয়ে বড় হয়েছে সেদিকে খেয়াল করেছ? তুমিই তো কিছু না বলে দিন দিন ওর সাহস বাড়িয়ে দিচ্ছ।
লাইলী নিচে এসে দেখল, সেলিম একা বসে আছে। বলল, তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে কিন্তু, আর শরীর ভালো নেই।
সেলিম বলল, চাচাজানের কি হয়েছে? আমাকে এতক্ষণ বলনি কেন চল তাকে দেখব।
এস বলে লাইলী আগে আগে উপরে গিয়ে তাকে বারান্দায় একটু অপেক্ষা করতে বলে ঘরে ঢুকে বলল, মা তুমি ওঘরে যাও। সেলিম এসেছে আৰ্বকে দেখতে।
হামিদা বানু তাড়াতাড়ি উঠে ভিতরের দরজা দিয়ে পাশের রুমে চলে গেলেন। লাইলী দরজার কাছে এসে সেলিমকে ভিতরে আসতে বলল। সেলিম ঘরে ঢুকে সালাম দিয়ে বলল, “চাচাজান আপনার কি হয়েছে?”
রহমান সাহেব সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, আমার বরাবর হার্টের অসুখ আছে। মাঝে মাঝে বেশ ট্রাবল দেয়। দু’চারদিন রেষ্ট নিলে ঠিক হয়ে যাবে। তা বাবা তোমাদের বাড়ির সব খবর ভালো তো?
সেলিম হ্যাঁ বলে জিজ্ঞেস করল, কোনো বড় ডাক্তারকে দেখান না কেন?
রহমান সাহেব বললেন, আমাদের অফিসের বড় ডাক্তার দেখছেন। এখন একটু ভালো আছি। লাইলী তোমার সঙ্গে বুঝি বাইরে কোথায় যাচ্ছিল? তোমাকে দু একটা কথা বলব বাবা, মনে আবার কষ্ট নিও না যেন। আব্বা কি কথা বলবে বুঝতে পেরে লাইলী সকলের অলক্ষ্যে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
সেলিম বলল, আপনি কি বলবেন বলুন, কিছু মনে করব না। আমি আপনার ছেলের মত। যদি অন্যায় কিছু করি, তা হলে গার্জেনের মত নিশ্চয় বলবেন।
বহমান সাহেব কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আমরা গরিব আমাদের তো কিছুই নেই বাবা। যতটুকু আছে তা হল ইজ্জত। জ্ঞ্যাতি শত্ৰু কম বেশি সকলেরই থাকে, আমারও আছে। তুমি বড় লোকের ছেলে। গাড়ি করে আমাদের বাড়ি আস এবং লাইলীর সঙ্গে তোমার খুব জানাশোনা, সেটা এরই মধ্যে পাড়াতে কানাঘুষো চলছে। আমার তো ঐ একটি মাত্র মেয়ে। তা ছাড়া আল্লাহপাকও বেগানা জোয়ান ছেলে মেয়েদের এক সঙ্গে মেলামেশা করতে নিষেধ করেছেন। তুমি শিক্ষিত ছেলে, অল্প কথায় সব কিছু নিশ্চয় বুঝতে পারছ? আমার মেয়ের নামে দুর্নাম রটলে আমি তার বিয়ে দিতে পারব না। আর পাঁচজনের কাছে মুখও দেখাতে পারব না। এই দেখ, মনের খেয়ালে তোমাকে কত কথা শুনিয়ে দিলাম।
সেলিম বলল, না-না চাচাজান, আপনি ঠিক কথা বলেছেন। পনার কথায় আমার মনে কোনো কষ্ট হয়নি। বরং আপনার এই সর্তকবাণী আম। জ্ঞানের চোখ খুলে দিয়েছে। আপনাকে বলতে আমার কোনো বাধা নেই, আপনারা কি মনে করবেন জানি না, আমি লাইলীকে বিয়ে করতে চাই। কথাটা নির্লজ্জার মত আমিই বলে ফেললাম। ইচ্ছা ছিল, আমার মাকে দিয়ে বলাব। আপনি অসুস্থতার মধ্যে দুঃশ্চিন্তায় থাকবেন, তাই বললাম। ভাববেন না, এটা বড় লোকের ছেলের খামখেয়ালী। আমি আল্লাহপাকের কসম খেয়ে বলছি, তিনি রাজি থাকলে কেউ আমার সিদ্ধান্ত বদলাতে পারবে না। এখন আমি বেশি কিছু বলতে চাই না। যা কিছু বলার আমার মা এসে বলবেন। অবশ্য মাকে এ পর্যন্ত আমি কিছুই জানাইনি। তবে যতদূর আমি আমার মাকে জানি, তিনি এই কাজে অমত করবেন না। আর যদি একান্ত রাজি না হন, তা হলে আমি সবকিছু ত্যাগ করে হলেও আমার সত্যকে মিথ্যা হতে দেব না।