সেলিমকে চুপ করে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে লাইলী বলল, ভিতরে এস না? এখানে রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে থাকলে লোকে ভাববে কি? তবুও সেলিমের সাড়া না পেয়ে গেটের কড়াটা জোরে নাড়া দিয়ে বলল, এই যে মশাই শুনছেন? লোকের বাড়িতে এসে এভাবে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা অভদ্রতার লক্ষণ।
কড়া নাড়ার শব্দ পেয়ে সেলিম চমকে উঠল। তারপর ভিতরে ঢুকল। লাইলী গেট বন্ধ করে সেলিমকে নিয়ে এসে ড্রইংরুমে দু’জন বসল। প্রথমে লাইলী বলল, এতদিন খবর না পেয়ে ভেবেছিলুম, তোমার কোনো অসুখ-বিসুখ হল কি না। আল্লাহ পাকের দরবারে লাখলাখ শুকরিয়া জানাই, তিনি তোমাকে সুস্থ রেখেছেন। বাড়ির সবাই ভালো আছে?
সেলিম বলল, হ্যাঁ, সকলে ভালো আছে। অফিসের কাজে এই কয়েকদিন খুব ব্যস্ত ছিলাম। এবারতো আমাকেই সব কিছু দেখাশোনা করতে হচ্ছে।
তুমি একটু বস, আমি চায়ের ব্যবস্থা করে আসি বলে লাইলী যাওয়ার উপক্রম করলে সেলিম আতঙ্কিত স্বরে বলল, যেও না প্ৰীজ।
লাইলী কাছে এসে তার কাঁধে একটা হাত রেখে বলল, আজ তোমার কি হয়েছে বলতো? তোমাকে যেন একটু এ্যাবনরম্যাল লাগছে।
সেলিম তার হাত ধরে সামনে চেয়ারে বসিয়ে বলল, তোমাকে দেখার আগে পর্যন্ত আমি নরম্যাল ছিলাম। তোমাকে দেখার পর থেকে এ্যাবনরমাল হয়ে গেছি। আমার বেনটা যেন ঠিকমত কাজ করছে না। কেবলই মনে হচ্ছে, তোমাকে অনেক দিনের জন্য হারিয়ে ফেলব। আমার চা-টা লাগবে না, তুমি চুপ করে বস। আর আমি আমার সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে তোমাকে দেখে তৃপ্ত হই।
লাইলী অভিমান ভরা কণ্ঠে বলল, এতদিন দেখার ইচ্ছে হয়নি বুঝি? এদিকে এই হতভাগী তোমার চিন্তায় অস্থির। ছেলেদের জান বড় শক্ত। শেষের দিকের কথাগুলো ভারী হয়ে এল।
সে জন্য মাফ চাইছি বলে সেলিম দুহাত জোড়া করল।
হয়েছে, হয়েছে বলে লাইলী স্মিত হাস্যে বলল, দু’মিনিট অপেক্ষা কর, আমি আসছি। সেলিমকে মাথা নাড়তে দেখে লাইলী আবার বলল, বা রে, আমি কি হারিয়ে যাচ্ছি? তুমি কষ্ট করে আমাদের বাড়িতে এলে, আর আমি তোমাকে এক কাপ চা দিয়েও আপ্যায়ন করাব না? আমরা গরিব তাই বলে মেহমানের যত্ন নেব না?
সেলিম বলল, তুমি বড়লোকের ছেলের সঙ্গে প্রেম করেও তাদেরকে হুল ফোঁটাতে ছাড় না। এক এক সময় ইচ্ছা হয়, সব কিছু ত্যাগ করে চিরকালের জন্য তোমার কাছে চলে আসি।
লাইলী সেলিমের কাতর উক্তি শুনে নিজের ভুল বুঝতে পারল। বলল, তুমি মনে এত বড় আঘাত পাবে জানলে কথাটা বলতাম না। আমার অন্যায় হয়ে গেছে। তারপর তার দুটো হাত ধরে বলল, আজ থেকে প্রতিজ্ঞা করলাম, এভাবে তোমাকে আর কখনো বলব না। তুমিও প্রতিজ্ঞা কর, আর কোনোদিন ঐরূপ চিন্তা করবে না। তারপর চোখের পানি গোপন করার জন্য মাথা নিচু করে নিল।
সেলিমও এতটা ভেবে বলেনি। লাইলী যেমন কথার ছলে বলেছে, সেও তেমনি বলেছে। লাইলীকে মাথা নিচু করে চুপ করে থাকতে দেখে বলল, দুজনেই কথাচ্ছলে বলেছি, এতে অন্যায় কারো হয়নি। হলেও সেম সাইড চার্জ, মামলা ডিসমিস। আমার দিকে তাকও তো?
লাইলী ধীরে ধীরে চোখভরা আঁশু নিয়ে তার দিকে চাইল।
এত সামান্য কথায় তার চোখে আঁশ দেখে সেলিম অবাক হয়ে লাইলীর ডাগর ডাগর পটলচেরা চোখের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল।
লাইলী নিজেকে সামলে নিয়ে আঁচলে চোখ মুছে বলল, আমাকে একটু যাওয়ার অনুমতি দাও বলে দাঁড়িয়ে পড়ল।
সেলিম আবার হাত ধরে বসিয়ে দিয়ে বলল, তুমি চা আনতে যাবে তো? আমি ওসব ফরমালিটি পছন্দ করি না।
তা হলে তুমি কি পছন্দ কর?
পৃথিবীর সমস্ত ঐশ্বর্যের বদলে তোমাকে কাছে পেতে চাই।
সেলিমের কথাগুলো ঠিক যেন কেউ লাইলীর মুখে একরাশ আবীর ছড়িয়ে দিল। সে কয়েক সেকেণ্ড লজ্জায় কথা বলতে পারল না। তারপর ধীরে ধীরে তার দিকে চোখ তুলে বলল, প্লীজ সেলিম, কথাগুলো একটু আস্তে বল, ভাবি হয়তো সব শুনতে পাচ্ছে।
সেলিম বলল, প্রতিদিন শুধু তোমার মুখে ভাবির কথা শুনি। কিন্তু সেই পূণ্যবতী নারীকে কোনোদিন দেখার সৌভাগ্য হল না। তুমি তাকে বলো, তিনি আমার বড় বোনের মত। এই অধম গোনাহগার ভাইয়ের কাছে কী আসতে পারেন না?
রহিমা এতক্ষণ পর্দার আড়াল থেকে তাদের কথোপকথন শুনছিল। আর থাকতে পারল না, দরজার পর্দা সরিয়ে বলল, আসতে পারি
লাইলী ফিস ফিস করে বলল, ভাবি।
সেলিম দাঁড়িয়ে সালাম দিয়ে বলল, আসুন ভাবি আসুন। তারপর সে এগিয়ে গিয়ে রহিমার পায়ের কাছে বসে কদমবুসি করে বলল, আমাকে ছোট ভাই মনে করলে কৃতার্থ হব।
রহিমা এতটা ভাবেনি। একটু থতমত খেয়ে গেল। তার কোনো ভাই নেই। তারা তিন বোন। তার মনটা আনন্দে ভরে গেল। মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করে বলল, উঠে বস ভাই। খুব খুশি হয়ে তোমাকে ভাই বলে গ্রহণ করলাম। আমাদের কোনো ভাই নেই। তারপর তোমরা গল্প কর, আমি চা তৈরী করে নিয়ে আসি।
রহিমা চলে যাওয়ার পর তারা দুজন দুজনের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। লাইলী মিষ্টি ভৎর্সনা করে বলল, এই কি হচ্ছে? ভাবি এসে দেখলে কি মনে করবে বল তো?
সেলিম বলল, যা মনে করার তা তো অনেক আগেই করে ফেলেছে। এখন আর নূতন করে কি ভাববে? সত্যি ভাবি যে কত ভালো, তা আজ বুঝতে পারলাম। চল একটু বেড়িয়ে আসি। পরীক্ষার পড়ার তো আর তাড়া নেই? তাকে চুপ করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আবার বলল, কী চাচী আম্মার বকুনীর ভয় হচ্ছে বুঝি?