একদিন ম্যানেজার সাহেব সোহানা বেগমকে বললেন, ছোট সাহেবের মধ্যে আমরা অনেক পরিবর্তন লক্ষ্য করছি। সে ক্রমশঃ ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। ম্যানেজার সাহেব প্রবীণ ব্যক্তি। মিলের জন্মদিন থেকে এই পদে আছেন। তিনি সেলিমকে ছোটবেলা থেকে দেখে আসছেন। তার অনেক আব্দার সাহেবের অগোচরে পূরণ করেছেন। তাই তাকে তিনি ছেলের মত সম্বন্ধ করে থাকেন।
কথাটা শুনে সোহানা বেগমের নারী হৃদয় আনন্দে ভরে গেল। আর সেই সঙ্গে আরিফের কথা মনে পড়ল। সেও আজ কত বছর এই ধর্মের জ্ঞানলাভ করার জন্য তাদের ছেড়ে চলে গেছে।
সোহানা বেগমকে চুপ করে থাকতে দেখে ম্যানেজার আবার বললেন, ছোট সাহেবকে আর সাহেব বলে চেনা যায় না। মিলের ছোট-বড় সকলের সঙ্গে এমনভাবে মেলামেশা করে; দেখে মনে হয় সেও যেন তাদেরই একজন।
সোহানা বেগম বললেন, আপনি তার গার্জেনের মত, কিছু বলেননি কেন?
বলিনি মানে? একদিন আমরা পাঁচ ছয়জন ছোট সাহেবকে এসব না করার জন্য বোঝাতে গেলাম। যেমনি দু-একটা কথা বলেছি, অমনি তার উত্তরে এমন সব হাদিস কালাম শুনিয়ে উদাহরণ দিয়ে আমাদেরকেই বুঝিয়ে দিল যে, আমরা আর কোনো যুক্তি খুঁজে পেলাম না।
সোহানা বেগম বললেন, ঠিক আছে, আপনি আসুন। আমি সময় মতো ওকে সবকিছু বুঝিয়ে বলব।
এদিকে ছোট সাহেবের পরিবর্তন মিলের ও অফিসের সকলের চোখে ধরা পড়ল। ছোট সাহেবকে তারা যেমন যমের মত ভয় করে, তেমনি পীরের মত ভক্তি-শ্রদ্ধা করে। ছুটির পর এবং ছুটির দিন সেলিম শ্রমিক কলোনিতে ঘুরে ঘুরে ছোট-বড় সকলের খোঁজ খবর নেয়। কারও কোনো অভিযোগ থাকলে তার প্রতিকারের ব্যবস্থা করে। তাদের অসুখে-বিসুখে নিজের টাকায় চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। সেলিমের এই সব দেখে বেশির ভাগ লোক বলাবলি করে, কি লোকের ছেলে কি হয়েছে। তারা আরও বলতে লাগল, ইনি নিশ্চয়ই অলি আল্লাহ ধরনের লোক হবেন। একদিন তারা মসজিদের ইমাম সাহেবকে ছোট সাহেবের কথা জিজ্ঞেস করল। উনি বললেন, আল্লাহপাক যাকে হেদায়েৎ করেন, তাকে কেউ ঠেকাতে পারে না। মনে হয়, উনি কোনো পরশ পাথরের সংস্পর্শে গেছেন।
ক্রমশঃ মিল-কারখানার শ্রমিকরা সেলিমকে অলি আল্লাহ ভাবতে লাগল। তারা তার সম্মানে দ্বিগুণ উৎসাহে কাজ করতে লাগল। এবছর অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেক বেশি মুনাফা হল।
রমজানের এক সপ্তাহ আগে সেলিম মায়ের অনুমতি নিয়ে বোর্ডের সব মেম্বরদের বোনাসের ব্যাপারে আলোচনা করার জন্য সকলকে একদিন বিকেলে বাড়িতে নিমন্ত্রণ করল। সেদিন ছুটির দিন। কাজের ব্যস্ততার জন্য বেশ কিছুদিন সেলিম লাইলীর খোঁজ-খবর নিতে পারেনি। আজ অবসর পেয়ে লাইলীদের বাড়িতে যাওয়ার জন্য বেলা তিনটের দিকে গাড়ি নিয়ে বেরুল।
সোহানা বেগম ছেলেকে অসময়ে বেরোতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, এখন আবার কোথায় যাচ্ছিস? বিকালে বোর্ডের মিটিং বসবে?
তুমি কিছু ভেবো না মা, আমি ঠিক সময় মত ফিরে আসব বলে সেলিম চলে গেল।
এদিকে লাইলী সেলিমের অনেকদিন খোঁজ খবর না পেয়ে খুব চিন্তায় দিন কাটাচ্ছে। তারও পরীক্ষা হয়ে গেছে। ভাবল, এতদিন হয়ে গেল তার খোঁজ নিচ্ছে না কেন? সে পুরুষ, তার তো উচিত আমার খোঁজ নেওয়া। একবার তাদের বাড়িতে যাওয়ার ইচ্ছা করেছিল; কিন্তু লজ্জা এসে তাকে বাধা দিয়েছে। কোনো কিছুতেই তার মন বসছিল না।
আজ রহিমা ভাবি তার মনমরা দেখে জিজ্ঞেস করল, কিগো সখি, মুখে হাসি নেই কেন? সখা বিনে দিন দিন যে শুকিয়ে যাচ্ছ? বলি এখন যদি এত? বিয়ের পরে যে কি করবে, তা উপরের মালিকই জানেন।
লাইলী কপট রাগ দেখিয়ে বলল, তোমার শুধু ঐ এক কথা। মানুষের মন তো আর সব সময় এক রকম থাকে না। নানান কারণে সেটা খারাপ হতে পারে।
তা হতে পারে, তবে আমি যে কারণটা বললাম, সেটাই কিন্তু আসল কারণ। কী ঠিক বলিনি?
তুমি তো দেখছি ভবিষ্যৎ বক্তা হয়ে গেছ?
তা একটু আধটু হচ্ছি বই কি?
তা হলে বলতো দেখি, সেলিম সাহেবের এতদিন খোঁজ-খবর নেই কেন?
রহিমা প্রথমে হেসে ফেলে বলল, ঠিক জায়গা মত তা হলে কোপটা পড়েছে? তারপর কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থেকে গম্ভীর হয়ে বলল, তিনি হয়তো কোনো কাজে আটকা পড়েছেন। সময় পেলেই তার প্রিয়ার খোঁজে ছুটে আসবেন। রহিমার কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে কলিং বেল বেজে উঠতে দুজনই চমকে উঠল। রহিমা বলল, এই রে, এ যে দেখছি সেলিম সাহেবের বেল বাজাবার কায়দা।
লাইলীও সেটা বুঝতে পেরেছে। সে লজ্জা পেয়ে কি করবে ভেবে ঠিক করতে পেরে চুপ করে বসে রইল।
কি হল বসে রইলে কেন? যাও ভদ্রলোককে অভ্যর্থনা করে নিয়ে এস। দরজা না খুলে দিলে বাড়িতে কি করে ঢুকবে? কেউ নেই মনে করে যদি ফিরে যান, তা হলে তো তখন তোমার আফশোসের সীমা থাকবে না।
কথাটি সঁচের মত লাইলীর বুকে বিধল। সে তাড়াতাড়ি উঠে গেটের দিকে গেল। ততক্ষণে আবার বেলটা বেজে উঠল। লাইলী দরজার ছিদ্র দিয়ে সেলিমকে দেখে খুলে দিল।
সেলিম লাইলীকে দেখে প্রথমেই সালাম দিল। তারপর জিজ্ঞেস করল, কেমন আছ?
সেলিমকে সালাম দিতে দেখে খুব অবাক হলেও লাইলী সালামের জবাব দিয়ে বলল, আল্লাহর রহমতে ভালো আছি। এস, ভিতরে এস, তুমি কেমন আছ?
সেলিম তখন আর লাইলীর কোনো কথা শুনতে পাচ্ছে না। এতদিন পর তার প্রিয়তমার দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে রইল। তার মনে হল, লাইলীকে অনেক বছর দেখেনি। বহুদিন পর তার প্রাণ শীতল হল।