সেলিম বলল, আপনার কথা কি সত্যি?
হারুন জীব কেটে “তওবা আসতাগফেরুলাহ” পড়ে বলল, কি যে বলেন সাহেব, আমি অশিক্ষিত হতে পারি; কিন্তু আলেমদের মুখে শুনেছি, যে মিথ্যা বলে তার ঈমান থাকে না। আবার কলমা পড়ে ঈমান আনতে হয়। আমি গরিব হতে পারি; কিন্তু মিথ্যাবাদী নই।
সেলিম একজন অশিক্ষিত শ্রমিকের মুখে মাতৃভক্তি ও ধর্মের কথা শুনে অবাক হয়ে বলল, আমি আপনার কাছ থেকে অনেক জ্ঞান পেয়ে আপনাকে ওস্তাদের আসনে বসালাম। আর এই নিন বলে একশত টাকার পাঁচখানা নোট মানি ব্যাগ থেকে বের করে তার দিকে বাড়িয়ে বলল, এটা আমি আমার ওস্তাদের নজরানা দিলাম। আপনি এই টাকা দিয়ে আপনার মাকে এখানে নিয়ে এসে হাসপাতালে ভর্তি করে দিন। তার যাবতীয় খরচ আমি দেব। তারপর বেয়ারাকে লেবার অফিসারকে ডাকতে বললেন।
সেলিমের কথা শুনে হারুন পাথরের মত জমে গেল। চিন্তা করল, সে জেগে আছে, না স্বপ্ন দেখছে? নিজের কান ও চোখকে বিশ্বাস করতে পারল না। কোথায় তার চাকুরি বরখাস্ত হওয়ার কথা, আর কোথায় এতসব কাণ্ড?
তাকে অবাক হয়ে চুপ করে থাকতে দেখে সেলিম বলল, নিন, টাকাটা পকেটে রাখুন।
নিজের অজান্তে কম্পিত হাতে হারুন টাকাটা নিয়ে পকেটে রাখল।
একটু পরে লেবার অফিসার এসে জিজ্ঞেস করলেন, আমাকে ডেকেছেন স্যার? তারপর হারুনকে চেয়ারে বসে থাকতে দেখে রেগেমেগে বলে উঠলেন, এই ব্যাটা উঠ, তোর সাহস তো কম না, সাহেবের সামনে তুই চেয়ারে বসে রয়েছিস। লেবার
অফিসারের নাম মামুন।
হারুনকে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে সেলিম বলল, আপনারা দু’জনেই বসুন। তারপর বললেন, আচ্ছা মামুন সাহেব, আপনি নিজেকে কি ভাবেন?
হঠাৎ এরকম প্রশ্নের জন্য মামুন সাহেব প্রস্তুত ছিলেন না। আমতা আমতা করে বললেন, কেন স্যার? কিছু অন্যায় করে ফেলেছি কি?
আপনি অন্যায় করেছেন কি না তা আমি জিজ্ঞেস করিনি, যা জিজ্ঞেস করেছি তার উত্তর দিন।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মামুন সাহেব বললেন, দেখুন স্যার।
আপনি স্যার স্যার করছেন কেন? আমার প্রশ্নের উত্তর দিন।
স্যার, নিজেকে আর কি ভাববো? তবে ওদেরকে বেশি প্রশ্রয় দিলে মাথায় উঠে যায়। তখন শত চেষ্টা করেও নামান যাবে না।
চুপ করুন, আমি এদের কথা জিজ্ঞেস করিনি, করেছি আপনার কথা।
মামুন সাহেব কি উত্তর দিবে ঠিক করতে না পেরে চুপ করে বসে রইলেন।
সেলিম বলল, মামুন সাহেব, আমাদের প্রত্যেকের জানা উচিত, আমরা আল্লাহ পাকের সৃষ্টির মধ্যে সর্বোত্তম ও সব থেকে প্রিয়। তার প্রধান কারণ হল, তিনি মানুষকে বিবেক বলে একটা অমূল্য জিনিষ দান করেছেন। যা অন্য কোনো সৃষ্টকে দেন নি। আমরা সেই শ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম বিবেক সম্পন্ন জীব হয়ে একে অন্যকে ঘৃণা করি, নিজেকে বড় মনে করি। এর কারণ কি জানেন? অহমিকা ও অজ্ঞতা। এইগুলোই মানুষকে বিভিন্ন গোত্রে, বিভিন্ন সম্প্রদায়ে ও বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করেছে। আর একই কারণের বশবর্তী হয়ে বিবেক বিসর্জন দিয়ে আমরা একে অন্যের প্রতি চরম দুর্ব্যবহার করি। অথচ আল্লাহপাক বলিয়াছেন, “এক মুমীন অন্য মুমীনের ভাই।“(১) আর আমাদের নবী (দঃ) বলিয়াছেন, “তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ঐ ব্যক্তি যে চরিত্রের দিক থেকে সর্বোত্তম।”(২) তাঁর দরবারে ধনী দরিদের কোনো তফাৎ নেই। যে কেউ তাঁকে ভয় করে আদর্শ চরিত্রবান হবে, সেই তাঁর কাছে উচ্চ আসন পাবে। তাঁর রাসূল (দঃ) হাদিসে বলেছেন “মানুষকে ঘৃণা করো না, পাপীকে ঘৃণা করো না, বরং পাপকে ঘৃণা করবে।“ যাই হোক, এই লোকটার বেতন সামনের মাস থেকে একশত টাকা বাড়িয়ে দেবেন। আর উনি যখন ছুটির দরখাস্ত করবেন, মঞ্জুর করবেন।
ইনার কেন, যে কোনো লোকের আবেদন সরাসরি আমাকে জানাবেন। আমাকে না জানিয়ে নিজে কিছু করবেন না। যদি কেউ ফাঁকি দেয়, কিংবা অন্যায় আচরণ করে, সে দিকে কড়া নজর রাখবেন। আমার কথায় আপনি রাগ বা মনে কষ্ট নেবেন না। আপনার ক্ষমতা কমানো হল না, যেমন আছে তেমনি থাকবে। শুধু কোনো কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়ার। আগে আমার পরামর্শ নেবেন। যান, এবার আপনারা আসুন।
ফেরার পথে হারুন মনে করল, এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল। সে ছোট সাহেবের জন্য আল্লাহর দরবারে দোয়া করতে লাগল। আর লেবার অফিসার মামুন সাহেব আশ্চর্য্য হয়ে ভাবতে লাগলেন, এর আগে তো কতবার ছোট সাহেবকে দেখেছি, তখন তো তাকে ধার্মিক বলে মনে হয়নি? তিনি ব্যাপারটা কিছু বুঝতে পারলেন না। আর এ ব্যাটা হারুনটাই বা কি বলল কি জানি? বড় সাহেব তো ধর্মের নামে জ্বলে উঠতেন। তারই ছেলে হয়ে ছোট সাহেব কেমন করে ধার্মিক বনে গেল?
যোহরের আযান ভেসে আসতে সেলিম নামায পড়ার জন্য মসজিদে রওয়ানা হল। সে সমস্ত মিলে ও অফিসে নোটিশ দিয়ে দিয়েছে, নামাযের সময় সব কিছু বন্ধ রেখে যেন সবাই মসজিদে নামায পড়তে যায়। নোটিশ পেয়ে নামাযীরা খুব খুশি হল। বেনামাযীরা খুশি না হলেও সেই সময়টা ক্যান্টিনে আড্ডা জমায়। সেলিম আজ পনের দিন হল নামায ধরেছে। এরই মধ্যে অফিসে সকলের জন্য পাঠাগার করেছে। সেখানে সব ধরনের বই আছে। তবে ইসলামিক বই-এর সংখ্যা বেশি। অবসর সময়ে সেও ইসলামিক বই পড়ে। কিছুদিন আগে সে বায়তুল মোকাররমে কি একটা জিনিস কিনতে গিয়েছিল। সে দিন ছিল জুম্মার দিন। দলে দলে টুপি পরা লোকদের মসজিদে ঢুকতে দেখে তার লাইলীর কথা মনে পড়ল। অনেক বোরখাপরা মেয়েকেও নামায পড়তে যেতে দেখে একজন মুসুল্লীকে জিজ্ঞেস করল, এখানে মেয়ে পুরুষ একসঙ্গে নামায পড়ে? লোকটা কয়েক সেকেণ্ড তার দিকে চেয়ে থেকে বলল, আপনি দেখছি কিছুই জানেন না। এখানে মেয়েদের নামায পড়ার জন্য আলাদা ব্যবস্থা আছে। সেলিমেরও মসজিদে গিয়ে নামায পড়ার খুব ইচ্ছা হল। কিন্তু কি ভেবে গেল না। আজ পর্যন্ত সে বায়তুল মোকাররমে কোনোদিন ঢুকেনি। শুধু দূর থেকে তার সৌন্দর্য উপভোগ করেছে। ঐ দিনই ইসলামি ফাউণ্ডেশন থেকে ইসলামিক অনেক বই কিনে আনে। তারপর নামায ধরেছে। ইসলামিক বই যত পড়তে লাগল তত ধর্মের প্রতি তার প্রগাঢ় ভক্তি জন্মাতে লাগল এবং ধর্মের আইন মেনে চলার প্রেরণা পেল। সে পাঁচ ওয়াক্ত নামায মসজিদে জামাতের সঙ্গে পড়ে। বাড়িতে এখনো পড়েনি। তাই বাড়িতে কেউ এখনও জানেনি যে, সে নামায পড়ে।