সেলিম একজন খুব ভালো ফুটবল খেলোয়াড়। জুডো, কারাত ও বক্সিং-এ পারদর্শি। নিজের গাড়ি নিজেই ড্রাইভ করে। তাদের দু’টো গাড়ি। অন্যটির জন্য একজন শিক্ষিত ডাইভার আছে। বন্ধু-বান্ধবী অনেক। আমীয়, অনামীয় ও ভার্সিটির কত মেয়ে তার পেছনে জোকের মত লেগে থাকে। সে সকলের সঙ্গে প্ৰায় সমান ব্যবহার করে। ফলে তারা সকলেই মনে করে, সেলিম তাকেই ভালবাসে। আসলে তাদের কাউকেই সে পছন্দ করে না। মনে কষ্ট পাবে বলে তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে। তাদের মধ্যে অনেকে গায়ে পড়ে ভাব করতে আসে। তারা তার চেয়ে তার ঐশ্বৰ্য্যকে বেশি ভালবাসে। তাই তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করলেও মনে মনে সবাইকে ঘৃণা করে। তাদের মধ্যে তার মামাত বোন রেহানা একটু অন্য টাইপের মেয়ে। দেখতে বেশ সুন্দরী আর খুব আল্টামডার্ণ। এ বছর বাংলায় অনার্স নিয়ে ভাসিটিতে ভর্তি হয়েছে। নিজেদের গাড়িতে করে প্রায় সেলিমদের বাড়িতে এসে তার সঙ্গে ব্যাডমিন্টন খেলে। সেলিমকে হারাতে না পারলেও সেও বেশ ভালই খেলে। তাকে অন্য সব মেয়েরা হিংসা করে।
সোহানা বেগমের ইচ্ছা ভাইঝিকে পুত্রবধূ করার। তুই একদিন খাবার টেবিলে কথায় কথায় জিজ্ঞেস করলেন, হ্যারে, তোর বান্ধবীদের মধ্যে কাউকে পছন্দ হয় নাকি?
সেলিম খাওয়া বন্ধ করে কয়েক সেকেণ্ড মায়ের মুখের দিকে চেয়ে থেকে বলল, হঠাৎ এরকম প্রশ্ন করছি কেন সে আশায় গুড়ে বালি, আমি এখন পাঁচ বছর বিয়ে করবে না।
সোহনা বেগম বললেন, তা না হয় নাই করলি, আমি বলছিলাম, রেহানাকে তার কি রকম মনে হয়?
সেলিম বলল, ভালোকে তো আর খারাপ বলতে পারব না, তবে ও খুব অহংকারী। মেয়েদের অহংকার থাকা ভালো না। এ বিষয়ে আর কিছু জিজ্ঞেস করো না, তা না হলে ঘর ছেড়ে অন্য কোথাও থাকার ব্যবস্থা করব।
ছেলের কথা শুনে সোহানা বেগম আর কিছু বলতে সাহস করলেন না। কারণ তিনি জানেন, একবার বিগড়ে গেলে সত্যি সত্যিই ঘর ছেড়ে চলে যাবে। এরপর থেকে তিনি আর ছেলেকে বিয়ের ব্যাপারে কোনো কথা বলেন নি।
এদিকে আরিফ ঘর থেকে আসার সময় নিজের হাত খরচের জমান হাজার নিয়ে বেরিয়েছিল। আগেই সে একজন আলেমের কাছে শুনেছিল, বাংলাদেশ ও পাক-ভারত উপমহাদেশের মধ্যে উত্তর ভারতে দেউবন্দ ইসলামী শিক্ষার শ্রেষ্ঠ পীঠস্থান। তাই সে মনে করল, যেমন করে হোক সেখানেই যাবে। সেখানে কিভাবে যাবে, তার খোঁজ খবর আগেই জেনে নিয়েছিল। ঘর থেকে আসার সময় একটা চিঠি লিখে রেখে প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র একটা ব্যাগে নিয়ে কোচে করে খুলনায় এসে হোটেলে উঠল। হোটেলের একজন খাদেমকে বিনা পাসপোর্টে ভারতে যাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করতে সে দালাল ঠিক করে দিল। যশোরে ও খুলনায় এরকম অনেক লোক আছে, যারা বিনা পাসপোর্টধারীকে টাকার বদলে গোপনে বর্ডার পার করে দেয়। এইভাবে তারা বেশ টাকা রোজগার করে। আরিফ ধর্মশিক্ষা করিতে যাবে শুনে সে টাকা না নিয়েই তাকে বর্ডার পার করে দিল। আরিফ টাকা দিতে গেলে লোকটা বলল, বাবা, সারাজীবন এই অন্যায় কাজ করে অনেক রোজগার করেছি। আজ একজন ধর্মশিক্ষাত্রীর কাছ থেকে টাকা নিতে পারব না, নিলে আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করবে না।
আরিফ ঐদিন কলিকাতায় পৌঁছে রাত্রের ট্রেনে চেপে বসল। সকাল সাতটায় মোগলসরাই ষ্টেশনে গাড়ি অনেকক্ষণ লেট করল যাত্রীদের ব্রেকফাষ্ট করার জন্য। গাড়ি ছাড়ার কয়েক সেকেন্ড আগে একজন মৌলবী ধরণের লোক উঠলেন। খুব ভীড়। অনেক লোক ঠাসাঠাসি হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ঐ লোকটা হাতের ব্যাগটা কোনো রকমে ব্যাংকারের উপর রেখে অনেক কষ্টের সঙ্গে দাঁড়ালেন। আরিফ সামনেই বসেছিল। তাড়াতাড়ি দাঁড়িয়ে তাকে বসার জন্য অনুরোধ করল।
লোকটি বলল, না-না, আপনিই বসুন। শেষে আরিফের জেদাজেদিতে বসলেন। তারপর কিছুক্ষণ আরিফকে লক্ষ্য করে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কোথায় থেকে আসছেন? কোথায় যাবেন?
আরিফ বলল, দেখুন, আমি আপনার ছেলের বয়সি, আমাকে আপনি করে না বলে তুমি করে বলুন। তারপর বলল, আমি বাংলাদেশ থেকে দেওবন্দের মাদ্রাসায় দ্বীনি এলেম হাসিল করার জন্য যাচ্ছি।
লোকটি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, এই প্রথম যাচ্ছ না কি?
জ্বি।
তুমি এতদিন কি পড়াশোনা করেছ?
এ বছর ম্যাট্রিক পাস করেছি।
তুমি তো দেশে থেকে মাদ্রাসায় পড়তে পারতে? এতদূরে আসার কি দরকার ছিল?
শুনেছি দেওবন্দ দ্বিনী শিক্ষার জন্য প্রসিদ্ধ।
ঠিকই শুনেছ। বাবা, কিন্তু আজকাল সে সব আদর্শবান শিক্ষক নেই। আর সেরকম ছাত্র সংখ্যাও খুব কম। তবে দেশের অন্যান্য জায়গার চেয়ে এখনও ওখানে সব থেকে ভালো শিক্ষা দেওয়া হয়। ওখানে অনেক ধরণের মাদ্রাসা আছে। আমার বাড়ি ওখানে। আমি এক মাদ্রাসার শিক্ষক। ছুটিতে বড় মেয়ের বাড়িতে গিয়েছিলাম। আগামীকাল মাদ্রাসা খুলবে। তাই বাড়ি ফিরছি। আমার সঙ্গে পরিচয় হয়ে ভালই হল। তোমাকে আর নতুন জায়গায় খোঁজাখুঁজি করতে হবে না। আমি সব ব্যবস্থা করে দেব। তুমি কি উর্দু একদম জান না? বলাবাহুল্য উভয়ে এতক্ষণ ইংরেজীতে কথা বলছিল।
না, আমি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়েছি, উর্দু জানি না।
তুমি যে এত দূর থেকে চলে এলে, তোমার মা-বাবা কিছু বললেন না?
তারা অন্য সমাজের মানুষ, ধর্মের কথা পছন্দ করে না। তাই একটা চিঠি লিখে সবকিছু জানিয়ে গোপনে চলে এসেছি।
তা হলে তো ওঁরা খুব চিন্তায় আছেন। এক কাজ করো, মাদ্রাসায় ভর্তি হওয়ার পর ওঁদেরকে চিঠি দিও। আর তুমিও কোনো চিন্তা করো না, আল্লাহপাকের যা মর্জি তাই। আমি যতটা পারি সব দিক থেকে তোমাকে সাহায্য করব।