সেলিম জিজ্ঞেস করল, ছেলেটার ঠিকানা তোমার মনে আছে?
মেয়েটা হ্যাঁ বলে ঠিকানাটা বলে দিল।
সেলিম চমকে উঠে গম্ভীর হয়ে কি যেন চিন্তা করতে লাগল।
লাইলী সেলিমের পরিবর্তন বুঝতে পেরে বলল, মনে হচ্ছে ছেলেটাকে তুমি চেন?
তোমাকে পরে বলব বলে সেলিম মেয়েটিকে গাড়িতে উঠিয়ে একেবারে নিজেদের বাড়ির গেটের বাইরে গাড়ি রেখে লাইলীকে বলল, তুমি একটু অপেক্ষা কর, আমি একে মায়ের কাছে দিয়ে আসছি। তারপর মেয়েটিকে নিয়ে সে বাড়ির ভিতরে চলে গেল।
সোহানা বেগম বারন্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। সেলিমের সঙ্গে ছেলে কোলে এক ভিখারিণীকে আসতে দেখে অবাক হলেন।
সেলিম তার কাছে গিয়ে বলল, এই মেয়েটা ভীষণ বিপদে পড়েছে। একে তোমার আশ্রয়ে দিলাম। এ আমাদের পরম আত্মীয়া। ভাগ্যদোষে আজ ভিখারিণী। এর বেশি কিছু এখন বলতে পারছি না। ফিরে এসে সব কিছু বলব। এদের আজ দু’দিন কিছু খাওয়া হয়নি। তুমি এদের খাওয়া ও থাকার ব্যবস্থা কর। মাকে অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে থাকতে দেখে সেলিম আবার বলল, তোমার ছেলে কখনো কোনো অন্যায় করেনি। আর কখন করবেও না। তারপর মাকে কথা বলার সুযোগ দিয়ে চলে গেল।
সোহানা বেগম নির্বাক হয়ে ছেলের চলে যাওয়া দেখলেন। এর মধ্যে রুবীনা ও কাজের দু’জন মেয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। তিনি কাজের মেয়েদের বললেন, এদের ভিতরে নিয়ে খাবার ব্যবস্থা কর। আর সিড়ির পাশে রুমটাতে থাকার ব্যবস্থা করে দাও।
ফিরে এসে সেলিম গাড়িতে উঠে বলল, এখন তো ক্লাস নেই, কোথায় যাবে, না। তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দেব?
লাইলী বলল, তোমার যা ইচ্ছে।
কিছুক্ষণ বেড়িয়ে ওরা একটা রেষ্টুরেণ্টে ঢুকে নাস্তার জন্য অর্ডার দিল।
লাইলী বলল, আমি কিছু কথা বলতে চাই।
বেশ তো বল।
চার পাঁচদিন আগে আমি একটা বই কেনার জন্য নিউমার্কেটে গিয়েছিলাম। সেখানে হঠাৎ রেহানার সঙ্গে দেখা। আমাকে একটা রেষ্টুরেণ্টে ডেকে নিয়ে গিয়ে চা খাওয়ার সময় বলল, সে তোমার বাগদত্তা। তোমার সাথে আমার পরিচয় কি করে হল তা জানতে চাইল। আমি শুধু সেই ঝড়ের দিনের দুর্ঘটনার কথা বলেছি। শুনে বলল, তুমি নাকি তোমার কর্তব্য করেছ। আমি যেন তোমাকে শুধু উপকারী বন্ধু বলে মনে করি। তার বেশি এগোলে আমাদের মত গরিবদের বিড়ম্বনা ও দুর্ভাগ্য ডেকে আনবে। আমি তার কথা শুনে মনে কিছু করিনি। বরং আমাকে সাবধান করে দেওয়ার জন্যে তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে চলে আসি।
সেলিম এতক্ষণ চুপ করে শুনছিল। লাইলী থেমে যেতে বলল, আমি জীবনে মিথ্যা কথা বলিনি। আর কখনো যেন বলতে না হয়। রেহানা আমার বাগদত্তা নয়। যদি তা হত, তা হলে নিশ্চয় আমি জানতাম। তবে বেশ কিছুদিন আগে মা একদিন আমাকে জিজ্ঞেস করছিল, ওকে আমার কেমন মনে হয়? তার উত্তরে আমি বলেছিলাম, “সে ভালো মেয়ে। ভালোকে তো আর খারাপ বলতে পারি না। তবে মেয়েটার একটু অহংকার আছে। মেয়েদের অহংকার থাকা ভালো নয়।” ব্যাস, ওর সম্পর্কে সব কথা এখানে ইতি টেনেছিলাম। রেহানা আমার মামাতো বোন। মা যদি তার ভাইয়ের সঙ্গে কোনো কথা বলে থাকে, তবে সে সব কিছু জানি না। আমার যতদুর মনে হয়, মা তার ভাইয়ের কাছে আমাদের দু’জনের বিয়ের সম্বন্ধে যখন কিছু বলা কওয়া করছে তখন হয়তো রেহানা শুনেছে। আর সেই জন্য তোমাকে ঐরকম কথা বলেছে। তবে মা আমার মতের বিরুদ্ধে কিছু যে করবে না, সে বিষয়ে আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিত। তুমি কিছু মনে করো না। আমি তোমাকে কথা দিয়েছি বললে ভুল হবে, বরং যেখানে আমি আমার মানস প্রিয়াকে আবিষ্কার করেছি, সেখানে দুনিয়াশুদ্ধ লোক আমার বিরুদ্ধে গেলেও আমি তাকে হারাতে পারব না। তার জন্য যদি সব কিছু ত্যাগ করতে হয় তাতেও পিছপা হব না। তুমি আমাকে সব কিছু বলে খুব ভালো করেছ। রেহানার কথা শোনার পরেও আমার প্রতি তোমার অকপট ব্যবহারে আমি খুব খুশি হয়েছি। আমার প্রতি তোমার বিশ্বাস দেখে আমার মন আনন্দে ভরে গেছে। সবশেষে একটা কথা বলে রাখছি, যদি কখনো আমাকে কোনো মেয়ের সঙ্গে অশোভন ভাবভঙ্গীতে নিজের চোখেও দেখ, তবু আমার ভালবাসাকে তুমি অবিশ্বাস করো না। জানবে, এটা কোনো ছলনাময়ীর ষড়যন্ত্র। আশা করি, এরূপ ঘটনা ঘটবে, তবু তোমাকে সাবধান করে রাখলাম।
লাইলী বলল, প্রেম মানেই কান্না। সেটা মানবিক হোক বা আধ্যাত্মিক হোক। কান্না আছে বলেই সুখের মূল্য আছে। মানুষ যদি দুঃখ না পেত, তা হলে সুখের মর্যাদা অনুভব করতে পারত না। তাইতো কবি বলেছেন—
“চিরসুখীজন ভ্রমে কি কখন
ব্যথিত বেদন বুঝিতে কি পারে?
কি যাতনা বিষে, বুঝিবে সে কিসে,
কভু আশীবিষে দংশেনী যারে।”
সংক্ষেপে বলতে গেলে, অভিজ্ঞতা ভিন্ন মানুষ সুখের আনন্দ, দুঃখের বেদনা, রোগের যন্ত্রণা, ভোগের মাধুর্য, ঐশ্বর্যের সুখ, দারিদ্রের যাতনা বুঝতে সক্ষম হয় না। আগুনে পুড়ে সোনা যেমন খাঁটি হয়, প্রকৃত মানুষ হতে হলে আমাদেরকেও তেমনি দুঃখ-কষ্ট, ব্যথা-বেদনা অতিক্রম করে অগ্রসর হতে হবে। আমরা সুখের জন্য যত চেষ্টা করি না কেন, আল্লাহপাক আমাদের তকদ্বীরে যতটা সুখ ও দুঃখ রেখেছেন, কোনো কিছুর দ্বারা তা কমবেশি করতে পারব না। তাই তিনি কোরআনপাকের মধ্যে বলেছেন-”যারা প্রকৃত জ্ঞানী তারা দুঃখ কষ্টের সময় বিচলিত না হয়ে আল্লাহ পাকের উপর সন্তুষ্ট থেকে সবর করে।”