পরীক্ষার পড়াতো ঠিকভাবে চালাতেই হবে। তোমরাও নিশ্চয় চলছে?
তোমার কথাই ঠিক। তবে সেলিম নামে একটা ছেলের স্মৃতি মাঝে মাঝে বেশ বিঘ্ন ঘটায়।
তাই নাকি? তা হলে তো ছেলেটার শাস্তি হওয়া উচিৎ। আমার কিন্তু লাইলী নামে একটি মেয়ের স্মৃতি মনে পড়লে খুব উৎসাহিত বোধ করি।
তা হলে মেয়েটা তোমার বেশ উপকার করেছে। তাকে পুরষ্কার দেওয়া উচিত বলে লাইলী হেসে ফেলল।
লাইলীর হাসি সেলিমকে পাগল করে দেয়। সে তার মুখের দিকে পলকহীনভাবে চেয়ে রইল।
তাকে ঐভাবে চেয়ে থাকতে দেখে লাইলী বলল, এই কি হচ্ছে? আবার অমনভাবে চেয়ে রয়েছে? কে যেন আসছে?
সেলিম তাড়াতাড়ি বলল, চল না একটু বেড়িয়ে আসি?
লাইলী চল বলে সেলিমের সঙ্গে লাইব্রেরী থেকে বেরিয়ে এসে গাড়িতে উঠল।
সেলিম গাড়ি ছেড়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, সেদিন তোমার মা-বাবা কিছু বলেনি?
মা অনেক বকাবকি করেছেন। আব্বা কিছু বলেননি।
তা হলে আজ যে আবার আমার সঙ্গে বেড়াতে এলে?
বারে, যার জন্যে চুরি করি, সেই বলে চোর। ঠিক আছে গাড়ি থামাও, আমি নেমে যাব।
বাব্বা, মেয়ের রাগ দেখ না? একটু রসিকতা করলাম। আর উনি কিনা রেগে গেলেন। বেশ তবে নেমেই যাও বলে সেলিম গাড়ির স্পীড খুব বাড়িয়ে দিল।
লাইলী ভয় পেয়ে বলল, একি হচ্ছে? প্লীজ এত জোরে চালিও না। আমার ভয় করছে বলে চোখ বন্ধ করে নিল।
সেলিম তার দিকে এক পলক তাকিয়ে নিয়ে অবস্থা বুঝতে পেরে স্পীড কমিয়ে দিয়ে বলল, সুন্দরী গো, এবার আঁখি খুলে দেখ, গাড়ি ধীরে চলছে।
লাইলী চোখ খুলে সেলিমের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়ে যত আনন্দ পাই, তার তুলনায় মায়ের বকুনী কিছুই নয়।
আচ্ছা দেখা যাবে, দু’দিন তোমাকে আটকে রাখব, তারপর বাড়ি পৌঁছে দেব। দেখব মায়ের কত বকুনি হুজম করতে পার?
আমার প্রিয়তম যদি তার প্রিয়তমাকে বকুনি খাইয়ে খুশি হয়, তা হলে আমি সন্তুষ্টচিত্তে মায়ের সব রকম বকুনি হজম করতে পারব।
তোমার বুদ্ধির ও কথার সঙ্গে আমি কোনোদিন পারব না। হার মানলাম সুন্দরী, আমায় ক্ষমা কর বলে সেলিম তার দিকে তাকিয়ে হাত জোড় করল।
এমন সময় সামনে থেকে একটা ট্রাককে ওদের গাড়ির দিকে সোজা আসতে দেখে লাইলী চিৎকার করে কিছু বলে উঠল।
সেলিম তার দৃষ্টিকে অনুসরণ করে একবারে সামনে একটা ট্রাক দেখে বিদ্যুৎ গতিতে নিজের গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে বিপদ থেকে রক্ষা পেল। দ্রুত গাড়ি ঘোরাবার ঝাঁকানিতে লাইলী টাল সামলাতে না পেরে সেলিমের গায়ের উপর পড়ে গিয়ে ভয়ে তাকে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল।
সেলিম গাড়ি সামলে নিয়ে এক হাত দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমো খেয়ে বলল, খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলে না? আজ আল্লাহ তোমার মত পুণ্যবতী নারীর কারণে এ্যাকসিডেন্টের হাত থেকে আমাদের রক্ষা করলেন। লাইলী তখনও ভয়ে কাঁপছিল। সেলিম রাস্তার একপাশে গাড়ি পার্ক করে তার পিঠে ও মাথায় হাত বুলোত বুলোত বলল, কি, এখনও ভয় দূর হচ্ছে না?
লাইলী লজ্জা পেয়ে সেলিমকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে বসে কয়েক সেকেণ্ড তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলল। তারপর বলল, আমি পুণ্যবতী পাপী হতভাগী? তা না হলে গাড়িতে উঠতে না উঠতে এ্যাকসিডেন্ট হতে যাচ্ছিল।
সেলিম বলল, তুমি কি যা তা বলছ? পাপ পুণ্যের কথা আল্লাহ জানেন। ভাগ্যের লিখন কেউ খণ্ডন করতে পারে না শুনেছি। সে কথাতো তুমি আমার চেয়ে বেশি জান। ভাগ্যে যদি দুর্ঘটনা থাকত, তা হলে হতই। নেই, তাই আমরা বেঁচে গেলাম। তা ছাড়া শুনেছি, আল্লাহ যা করেন, বান্দাদের মঙ্গলের জন্যই করেন। ঐসব নিয়ে অত চিন্তা করে কান্নাকাটি কর না। তারপর সেলিম পকেট থেকে রুমাল বের করে লাইলীর চোখ মুখ মুছে দিল।
এমন সময় একটা সুন্দরী ও স্বাস্থ্যবতী যুবতী ময়লা কাপড় পরনে একটা ছেলে কোলে করে মানমুখে ওদের কাছে এসে হাত পেতে বলল, আপনারা দয়া করে আমাকে কিছু সাহায্য করুণ। আজ দুদিন যাবত বাচ্চাটাকে কিছু খেতে দিতে পারিনি।
সেলিম বলল, কোনো বাড়িতে কাজ করে খেতে পার না? যাও এখান থেকে, পেটে ভাত জোটে না বাচ্চা এল কোথা থেকে?
মেয়েটি বলল, আপনারা বড়লোক, গরিবের খবর রাখেন না। আমি কি আর সখ করে ভিখারিণী হয়েছি? গরিব ঘরে জন্মান যে কত বড় পাপ, তা যদি জানতেন, তা হলে ঐসব কথা বলতে পারতেন না। গরিব ঘরের মেয়েদের এই রকম পরিণতির জন্য আপনাদের মত ধনী লোকেরাই বেশি দায়ী।
লাইলী বলল, কেন কি হয়েছে? তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে তুমি লেখাপড়া জান?
মেয়েটি বলল, কি আর বলব, সবই ভাগ্যের ফের। আমাদের বাড়ি কুমিল্লা জেলার দেবীদ্বার থানায়। আমার বাবা একজন গরিব কৃষক। আমরা শুধু চার বোন। যে টুকু জমি ছিল, তা বিক্রি করে বাবা তিন বোনের বিয়ে দেয়। আমি ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়েছি। একা বাবা গতরে খেটে সংসার চালাবেন না আমার পড়ার খরচ যোগাবেন। অভাবের তাড়নায় পড়া বন্ধ হয়ে যায়। আর বাবা যৌতুকের টাকা যোগাড় করতে পারেনি বলে আমার বিয়েও দিতে পারেনি। একদিন গ্রামের মাতব্বরের বাগান থেকে শুকনো ডালপালা আনছিলাম। বাগানের গেটে একটা অচেনা সুন্দর ছেলেকে পথ আগলে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। সে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, বাঃ এত সুন্দর মেয়ে তুমি, আর কাঠ কুড়িয়ে বেড়াচ্ছ? আমি বললাম, কি করব বলুন আমরা গরিব। এগুলো নিয়ে গেলে রান্না হবে। আপনি দয়া করে পথ ছাড়ুন। তখন ছেলেটি বলল, তুমি আগামীকাল দুপুরে এখানে এস, তোমার সঙ্গে আমার বিশেষ কথা আছে। এই বলে সে চলে গেল। ছেলেটাকে দেখে আমারও খুব ভালো লাগল। পরের দিন ভয়ে ভয়ে সেখানে গেলাম। দেখি ছেলেটা বাগানের ভিতর দাঁড়িয়ে আছে। আমি কাছে গিয়ে দাঁড়াতে নাম জিজ্ঞেস করল। বললাম, আমার নাম আসমা। ছেলেটা বলল, বেশ সুন্দর নাম তোমার। আমার নাম মনিরুল। তোমাকে কি জন্য ডেকেছি জান? আমি মাথা নেড়ে বললাম না। ছেলেটি তখন বলল, আমার বাড়ি ঢাকায়। মাতব্বরের ছেলে শামীম আমার বন্ধু। ওর সাথে কয়েকদিন বেড়াতে এসেছি। তোমাকে দেখে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই। আমি লজ্জা ও ভয় পেয়ে বললাম, আপনি আমার বাবার সঙ্গে কথা বলুন। ছেলেটি তখন বলল, ঠিক আছে তাই বলব। তারপর থেকে আমরা প্রতিদিন লুকিয়ে দেখা করতাম। সে আমাকে নানান প্রলোভন দেখাতো। এর মধ্যে একদিন দুর্বল মুহূর্তে হঠাৎ ছেলেটা আমার সর্বনাশ করে ফেলে। আমি কাঁদতে থাকি। ছেলেটা আমাকে বুঝাল যে, সে আমাকে খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে করবে। তারপর থেকে নানান কথা বলে আমার মধু আহরণ করতো। এভাবে প্রায় একমাস চলার পর হঠাৎ ছেলেটা আসা বন্ধ করে দিল। খবর নিয়ে জানলাম, সে ঢাকা চলে গেছে। মনে করলাম কোনো কারণে হয়তো তাড়াতাড়ি করে চলে গেছে, নিশ্চয় চিঠি দেবে। সে। রকম কথাবার্তা আমাদের মধ্যে হয়েছিল। তার ঠিকানাও আমাকে দিয়েছিল। সেই ঠিকানায় অনেকগুলো চিঠি দিয়ে ব্যর্থ হই। যখন তিন মাস পার হয়ে গেল এবং তাঁর কোনো খবর পেলাম না তখন আমি দিশেহারা হয়ে পড়লাম। কারণ এই ছেলেটা তখন আমার পেটে এসেছে। লজ্জায় ও ঘৃণায় কয়েকবার আত্মহত্যা করতে গেছি। কিন্তু পারিনি। জানাজানি হয়ে গেলে বাবার ইজ্জত যাবে, বাবা-মার কাছে মুখ দেখাব কি করে? এইসব সাত-পাঁচ ভেবে সামান্য কয়েকটা টাকা জোগাড় করে তার ঠিকানায় আসি। প্রথমে গেটে দারোয়ানের কাছে বাধা পাই। সাহেব আমার আত্মীয় বলাতে সে ভিতরে যেতে দেয়। আমি মনিরুলের খোঁজ করলাম। সে তখন বাড়িতে ছিল না। তার বাবা ছিলেন। তিনি আমার পরিচয় ও আসার কারণ জিজ্ঞেস করলেন। আমি যতটা সম্ভব অকপটে সবকথা খুলে বললাম। তখন তিনি আমাকে কুৎসিত গালাগালি করে দারোয়ান দিয়ে তাড়িয়ে দেওয়ার সময় বললেন, টাকা কামাবার জন্য এরকম কত মেয়ে শহরের বাড়িতে বাড়িতে ঘুরে ঘুরে অভিনয় করে বেড়ায়। আবার যদি কোনোদিন এ বাড়িতে আস, পুলিশে ধরিয়ে দেব। শেষে আমার হাতে কিছু টাকা দিয়ে বললেন, যাও, আর কোনোদিন আসবে না। আমি টাকাটা তার পায়ের কাছে ফেলে দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে চলে আসি। অনেক কষ্টে একটা বাড়িতে ঝিগিরি কাজ জোগাড় করি। কিছুদিন পর তারা যখন বুঝতে পারল আমার পেটে বাচ্চা আছে তখন আমাকে নষ্ট মেয়ে ভেবে তাড়িয়ে দিল। শেষকালে স্বামী আছে খাওয়াতে পারে না, তাই মেরে ধরে তাড়িয়ে দিয়েছে বলে অন্য একটা বাড়িতে কাজ পাই। সেখানেই এই বাচ্চাটা হয়। বাচ্চাটা হওয়ার পর যখন আমার স্বাস্থ্য ভালো হল তখন বাড়ির কর্তার নজর আমার উপর পড়ল। সে উচ্চ শিক্ষিত সরকারী অফিসার। তার বয়সও বেশ হয়েছে। উনার এক ছেলে। তিনি বিদেশে পড়তে গেছেন। ঐ রকম লোক হয়ে সুযোগ পেলে আমার গায়ে হাত দেবার চেষ্টা করতেন। তার স্ত্রী আমাকে মেয়ের মত ভালবাসতেন। একদিন দুপুরে একা পেয়ে লোকটা আমাকে জড়িয়ে ধরেন। আমি তখন মেয়ের তুলনা দিয়ে কাকুতি-মিনতি করছি। ঠিক সেই সময় উনার স্ত্রী ঘরে এসে পড়েন। লোকটা তখন আমাকে ছেড়ে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যান। উনার স্ত্রীও কোনো কথা না বলে স্বামীকে অনুসরণ করলো। সারাদিন আমি নিজের ঘরে বসে বসে কেঁদে কাটাই। সেই রাতের ভোরে তাদের বাড়ি থেকে লুকিয়ে চলে আসি। আজ দুদিন নিজে ও বাচ্চাটা পানি খেয়ে রয়েছি। কারও কাছে হাত পাতলে তারা আমার শরীরের দিকে এমনভাবে তাকিয়ে থাকে যেন গিলে খাবে। সে জন্য কারও কাছে হাত পাতিনি বলে মেয়েটা কেঁদে ফেলল। তারপর বলল, আপনাদেরও ছোট ভাইবোন আছে। আমাকে না হয় নাই দিলেন। ছেলেটা তো আর কোন পাপ করেনি। তাকে না হয় কিছু দিন। এক নাগাড়ে এতকথা বলে মেয়েটা হাঁপাতে লাগল।