সোহানা বেগম বলে উঠলেন, এবার তোমরা সবাই খাবে চল, রাত বেশি হয়ে যাচ্ছে। তিনি রহিমকে ডেকে ডাইনিং রুমে খাবার সাজাতে বললেন।
এদিকে যারা লাইলীকে অপমান করতে চেয়েছিল, তারা ব্যর্থ হয়ে মনে মনে গুমরাতে লাগল। ছেলেরা তো লাইলীর রূপের ও সুরের প্রশংসায় মশগুল।
রেজাউল সেলিমের কাছে গিয়ে আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করল, দোস্ত, এই কী সেই মেয়ে, যার সঙ্গে তুই ভার্সিটিতে এ্যাকসিডেন্ট করেছিলি? আর মিল্লাদুন্নবীর ফাংশনের দিন যার সঙ্গে দেখা করার জন্য কবিতা গেয়েছিলি?
সেলিম বলল, তুই ঠিক ধরেছিস। আমার কথা সত্য না মিথ্যা তার প্রমাণ পেলি তো?
রেজাউল বলল, সত্যি দোস্ত, তুই মহাভাগ্যবান। এরকম মেয়ে বর্তমান দুনিয়ায় খুব বিরল।
একটু পরে রহিম এসে বলল, আপনারা সবই খাবেন চলুন।
একে একে সকলে ডাইনিং রুমে গেল। শুধু লাইলী একা বসে রইল।
সেলিম ফিরে এসে বলল, তুমি আমাদের সঙ্গে খাবে না?
লাইলী করুণসুরে বলল, প্লীজ সেলিম, তুমি মনে কিছু করো না। আমি কিছুতেই সকলের সাথে খেতে পারব না। তুমি যাও, নচেৎ অতিথিরা মনে কষ্ট পাবে। সেলিম চলে যাওয়ার পরও লাইলী চুপ করে বসে সারাদিনের ঘটনাগুলো একের পর এক ভাবতে লাগল।
এদিকে খাবার টেবিলে লাইলীকে দেখতে না পেয়ে একজন জিজ্ঞেস করল, কই নূতন অতিথিকে তো দেখতে পাচ্ছি না?
কেউ কিছু বলার আগে রেহানা বলে উঠল, উনি পর্দানশীন মহিলা, ছেলেদের সঙ্গে খান না। কথাটা শুনে অনেকে হেসে উঠল।
এমন সময় সোহানা বেগম ঘরে ঢুকে তাদের কথা শুনে বুঝতে পারলেন, লাইলী খেতে আসেনি। সেলিমকে জিজ্ঞেস করলেন, হ্যারে, লাইলী কোথায়?
সেলিম বলল, সে ঐ রুমে বসে আছে। তুমি তাকে আলাদা খাওয়াবার ব্যবস্থা কর।
সোহানা বেগম লাইলীর গজল ও কথা শুনে খুব মোহিত হয়ে গিয়েছিলেন। মনে মনে অনেক তারিফ করেছেন। তিনি লাইলীকে ডেকে অন্য রুমে খেতে দিলেন। সকলে বিদায় নিতে রাত্রি দশটা বেজে গেল। সোহানা বেগম লাইলীকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বলে সেলিমকে সাথে যেতে বললেন।
যেতে যেতে গাড়িতে সেলিম বলল, সত্যি বলছি আজ যে রুবীনার বার্থডে পালন করা হবে, সে কথা আমার একদম মনে ছিল না। তবে একটা কথা মনে রেখ, যারা তোমাকে হিংসা করে অপমান করতে চেয়েছিল, তারা নিজেরাই অপমানিত হয়েছে। আর আমি আমার প্রিয়তমাকে অনেক বেশি জানতে পারলাম। তোমার গলা যে এত ভালো, আমি প্রশংসা করার ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না।
লাইলী লজ্জা পেয়ে বলল, কি জানি, আমি তো কোনোদিন গলা সাধিনি। আর কোনোদিন গানও গাইনি। যদি সত্যি তোমার কাছে ভালো লেগে থাকে, তা হলে নিজেকে ধন্য মনে করছি। তারপর আবার বলল, আমি কাউকে অপমান করার উদ্দেশ্যে কিছু বলিনি। বরং আমি ভাবছি, আমার জন্য তোমাদের কোনো অপমান হল কি না?
সেলিম বলল, তুমি আমাদের ইজ্জৎ বাড়িয়ে দিয়েছ। ওরা নিজেদেরকে খুব সুন্দরী ও ভালো গায়িকা মনে করত। আজ তাদের সেই অহংকার চূর্ণ হয়ে গেছে।
লাইলী বলল, তোমার গান শুনে আমি কিন্তু নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম। তোমার গলা যে কত সুন্দর তার প্রশংসা করা আমার দ্বারা সম্ভব না।
দূর আমার গলা আবার গলা। কতদিন ওস্তাদ রেখে গলা সেধে এটুক তৈরি করেছি। আরে তুমি এমনি যা গাইলে, এর আগে জীবনে কোনোদিন শুনিনি।
এরপর লাইলী কথা খুঁজে না পেয়ে বলল, রাত অনেক হয়ে গেল, আব্বা-আম্মা খুব চিন্তা করছেন। অনেক বকাবকি ও করবেন।
আজ আমার জন্য না হয় একটু বকাবকি খেলে। ততক্ষণে তারা লাইলীদের বাড়ির গেটে পৌঁছে গেল। ড্রাইভার গাড়ি থামিয়ে দরজা খুলে দিল।
লাইলী নেমে কলিং বেলে চাপ দিয়ে বলল, ভিতরে আসবে না?
তুমি বললে নিশ্চয় আসব।
জলিল সাহেব গেট খুলে দিয়ে লাইলীর সঙ্গে সেলিমকে দেখে বললেন, আরে সেলিম সাহেব যে, আসুন ভিতরে আসুন। লাইলী লজ্জা পেয়ে পাশ কাটিয়ে নিজের রুমে চলে গেল। জলিল সাহেব সেলিমকে সঙ্গে করে নিয়ে ড্রইংরুমে বসিয়ে বললেন, রাত্রে যখন এসেই পড়েছেন তখন একমুঠো ভাত খেয়ে যান।
সেলিম বলল, এইমাত্র খেয়ে আসছি। এখন কিছু খেতে পারব না।
অন্ততঃ এক কাপ চা তো চলবে। তারপর উঠে গিয়ে স্ত্রীকে চা তৈরি করে লাইলীর হাতে পাঠিয়ে দিতে বললেন।
একটু পরে লাইলী দুকাপ চা নিয়ে এল।
চা খেয়ে সেলিম বিদায় নিয়ে চলে গেল।
লাইলী খালি কাপ নিয়ে ফিরে এলে হামিদা বানু রাগের সঙ্গে বললেন, আজকাল মেয়েদের লজ্জা সরম বলতে কিছুই নেই। তুই যে সারাদিন ঐ ছেলেটার সঙ্গে ঘুরে বেড়ালি, তোর লজ্জা করল না? কলিযুগ ঘোর কলিযুগ। তা না হলে জোয়ান জোয়ান ছেলে-মেয়েরা একসঙ্গে লেখাপড়া ও ঘোরাফেরা করে? মেয়েদের পর্দা বলতে আর কিছুই রইল না। এইজন্য মানুষ দিন দিন রসাতলে যাচ্ছে। আর কোনোদিন এভাবে যাবি না বলে দিচ্ছি?
রহমান সাহেব লাইলী ফেরার খবর শুনে শুবার ব্যবস্থা করছিলেন। স্ত্রীর কথা শুনে বললেন, আহা রাগারাগি করছ কেন। যা বলবে মেয়েকে তো ভালো মুখে বুঝিয়ে বলতে পার?
হামিদাবানু গর্জে উঠলেন, তুমি থামো, তোমার আস্কারা পেয়ে তো ওর এত সাহস হয়েছে। মেয়ে ছোট নাকি যে, তাকে বুঝিয়ে বলতে হবে? সে কি কিছু বোঝে না, না জানে না? পরের ছেলের সঙ্গে ঘুরে বেড়ালে বংশের ইজ্জত বাড়বে বুঝি?