এদিকে লাইলী লজ্জায় ও অপমানে ঘামতে শুরু করল। আল্লাহপাকের কাছে মনে মনে সাহায্য চাইতে লাগল। কিছুক্ষণ মেঝের দিকে চেয়ে থেকে নিজেকে সামলে নিল। সে শাড়ীর উপর খাড় গাঁটের নিচ পর্যন্ত কামিজের মত সাদা বোরখা পরেছে আর মাথা ও বুক অন্য একটা কাপড় দিয়ে ঢেকে শুধু মুখটা খোলা রেখেছে। এখন শুধু তার হাতের দুই কজী ও চুলের নিচ থেকে মুখমণ্ডল দেখা যাচ্ছে।
সে যখন রেহানার পাশে দাঁড়াল তখন সকলে তার দিকে চেয়ে স্তম্বিত হয়ে গেল। এত রূপসী মেয়ে তারা এর আগে কখনও দেখেনি। সকলে নিস্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। ছেলেরা মনে করল, যে মেয়ের এতরূপ, তার গলার স্বর না জানি কত মিষ্টি। সকলে শুধু এক পলক তার মুখ দেখেছে। কারণ সে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
তাকে ঐ অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সেলিম ব্যাপারটা বুঝতে পেরে নিজেকে অপরাধী মনে করল। সে তার দিকে এগিয়ে যেতে লাগল।
এমন সময় লাইলী এগিয়ে গিয়ে সকলের সামনে দাঁড়িয়ে মুখ তুলে সকলের দিকে চেয়ে আসসালামু আলাইকুম বলল। সেলিম আসতে আসতে থমকে দাঁড়িয়ে গেল। কেউ সালামের উত্তর দিল না। লাইলী সেটা গ্রাহ্য না করে বলল, দেখুন, আমি স্বইচ্ছায় আপনাদের এই ফাংসানে আসিনি, দৈবচক্রে এসে পড়েছি। এই সমাজের রীতিনীতি সম্বন্ধে আমি অনভিজ্ঞ। আর আমি গান বাজনাও জানি না। আপনাদেরকে আনন্দ দেওয়ার মত কোনো বিদ্যা আমার জানা নেই। তবে যদি অনুগ্রহ করে সকলে অনুমতি দেন, তা হলে সেই সৃষ্টিকর্তা, যিনি পরম দাতা দয়ালু, তাঁর ও তার প্রেরিত রাসূলের (দঃ) কিছু সুতীগান ও আলোচনা করে শোনাতে পারি। তারপর সে অনুমতির পাওয়ার আশায় সকলের দিকে চেয়ে মাথা নিচু করে নিল।
এতক্ষণ যেন চাঁদ সেখানে আলো ছড়াচ্ছিল, লাইলী মাথা নিচু করে নিলে সকলের মনে হল চাঁদ যেন মেঘের ভিতরে ঢুকে গেল। বেশ কয়েক মিনিট কেউ কোনো কথা বলতে পারল না। সোহানা বেগম এবং আরও দুই তিনজন বয়স্কা মহিলা একসঙ্গে বলে উঠলেন, বেশ তো মা, তুমি কি শোনাতে চাও শোনাও।
লাইলী মুখ তুলে সকলের দিকে চেয়ে উর্দুতে একটা গজল গাইল।
“খুদী কো মিটাকর খোদা সে মিলাদে,
শুরুর আওর মস্তী কী দৌলত লুটাদে,
শরাবে হকিকত কী দরিয়া বাহাদে,
নেগাহুঁকী সাদকে মে বেখুদ বানাদে,
মুঝে সোফিয়া জামে ওহাদাৎ পিলাদে,
খুদীকো…
আজল সেহুঁ কুশতা ম্যায় তেরী আদাকা,
নাজীনে কী হজরত নাগাম হ্যায় কাজাকা,
না জেঁইয়া আসর কা না খাঁহাঁ দোওয়া কা,
মাসিহা সে তালেব নেহী ম্যায় সে কা কা,
মরীজে আলম হুঁ তেরা তু দোওয়া দে,
খুদী কো………
খুদারা কভি মেরী তুরজাত পীয়া কর,
বাসাদ নাজ হালকি সে ঠোকর লাগা কর;
দেখা মেরী খবিদা কীসমত জাগা কর,
সাদা কুম বেজনী কি মুজকো শুনা কর,
ম্যায় বেদম হুঁ আয়া ফাখরে ইসা জিলাদে
খুদী কো মিটা কর খোদা সে মিলাদে।”
লাইলী থেমে যাওয়ার পর কিছুক্ষণ ঘরের মধ্যে পিন অফ সাইলেন্স বিরাজ করতে লাগল। সকলে বোবা দৃষ্টিতে তার দিকে করুণভাবে চেয়ে রইল। তাদের কানে এখনও লাইলীর সুমধুর ঝংকার বেজে চলেছে। যদিও অনেকে এই উগজলের মানে বুঝতে পারেনি, তবুও লাইলীর কোকিলকণ্ঠি গলা ও দরদভরা সুর সবাইকে যেন পাথরের মত স্তব্ধ করে দিয়েছে। সব থেকে বেশি অভিভূত হয়েছে সেলিম। সে ভাবল, লাইলীর সুরের কাছে তাদের সকলের সুরের কোনো তুলনা হয় না।
নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে প্রথমে সালমা হাততালি দিতে সকলে সম্বিত ফিরে পেয়ে তারাও হাততালি দিতে লাগল। সকলকে থামিয়ে সালমা বলল, আপনার গলা এত সুন্দর? আপনি যদি রেডিও, টিভি কিংবা ফিলম লাইনে যান, তা হলে তারা আপনাকে লুফে নেবে। আমি কত গায়ক-গায়িকার গান শুনলাম, কিন্তু আপনারটা তলনাহীন।
লাইলী এতক্ষণ লজ্জা পেয়ে জড়ো সড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। সালমা থেমে যাওয়ার পর তার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনার জওয়াবে অনেক কথা বলতে হয়। সেগুলো বললে আপনারা শুনে হয়তো অসন্তুষ্ট হবেন। তাই বেশি কথা না বলে এক কথায় বলছি, ইসলামে গান-বাজনা নিষিদ্ধ। তারপর সকলের দিকে এক নজর দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে আবার বলল, আল্লাহপাক তাঁর সৃষ্টির সেরা মানুষকে নর ও নারী দুটি আলাদা সত্ত্বে সৃষ্টি করেছেন। তাদের দৈহিক ও মানসিক দিক ভিন্ন করেছেন এবং তাদের কাজ ও তার ধারা আলাদা করে দিয়েছেন। কিন্তু আমরা তার সৃষ্টির সেরা জীব হয়ে তার আদেশ অমান্য করে নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য নিজেরা আইন তৈরি করে নিয়েছি। যার ফলে আজ সারাবিশ্বে অশান্তির আগুন জ্বলছে। ছেলে-মেয়ের সঙ্গে পিতামাতার এবং স্ত্রীদের সঙ্গে স্বামীদের মনমালিন্য শুরু হয়ে সংসার নরকে পরিণত হতে চলেছে। এইসব কথা বলতে গেলে সরারাতেও শেষ হবে না। তা ছাড়া এমন আনন্দ উৎসব ফাংশানে এইসব আলোচনাও খাপ খায় না। তবুও আর একটু বলে শেষ করছি। প্রত্যেক মসুলমানের উচিত পৃথিবীকে জানার আগে নিজেকে জেনে নেওয়া। অর্থাৎ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সভ্যতা, ভাষা, ধর্ম ও মতামতকে প্রধান্য দেওয়ার আগে তার নিজের ধর্মের সংস্কৃতি ও কৃষ্টিকে জেনে নেওয়া দরকার। যদি তারা তাই করত, তা হলে বুঝতে পারত, পৃথিবীর অন্যান্য সবকিছুর চেয়ে ইসলামের অর্থাৎ আল্লাহপাকের আইন কত সুষ্ঠ, কত সুন্দর, কত। সহজতর। দূর থেকে লম্বা কুর্তা ও টুপী পরা মৌলবী এবং বোরখা পরা মেয়ে দেখে আজকাল বেশিরভাগ লোক সেকেলে, ন্যাষ্টি বলে নাক সিটকায়। আবার অনেকে ইসলামের আইন এযুগে মেনে চলা খুব কঠিন ও অচল বলে মনে করে। অথচ আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনের মধ্যে বলছেন, “আমি বান্দাকে এমন কাজ করতে আদেশ দিই নাই যা তাদের পক্ষে মেনে চলা কঠিন।”(২) আর বেশি কিছু বলে আপনাদেরকে বিরক্ত করতে চাই না। এতক্ষণ যা কিছু বললাম, তাতে হয়তো অনেক ভুলত্রুটি থাকতে পারে, সে জন্য ক্ষমা চাইছি। তারপর সে ফিরে এসে নিজের চেয়ারে বসে ঘামতে লাগল। তার মনে হল, সে যেন আগুনের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এল। এরপরও কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতা বিরাজ করল।