সেলিম এতক্ষণ কোনো কথা বলেনি। সবাইকে বোকা বানাবার জন্য বলল, মা, তুমি কিছু বলল না, আমি লাইলীকে রেহানার শেষ প্রশ্নের উত্তরটা দিতে অনুরোধ করছি।
লাইলী কয়েক মুহূর্ত মাথা নিচু করে রইল, তারপর সেলিমের দিকে একবার চেয়ে নিয়ে বলল, একবার আমি ভীষণ বিপদে পড়েছিলাম। সেই সময় সেলিম সাহেব ও তার মা আমাকে সেই বিপদ থেকে উদ্ধার করেন। যদি ওঁরা সেদিন আমাকে ঐ বিপদ থেকে উদ্ধার না করতেন, তা হলে আমি আর ইহজগতে কারও কাছে মুখ দেখাতে না পেরে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হতাম। সেই লোক যদি আমাকে কোথায় নিয়ে গিয়ে থাকে এবং এখানে এনে থাকেন, তা হলে কি করে আমি বাধা দিতে পারি বলুন? অত অকৃতজ্ঞ হতে বিবেকে বেধেছে। ওঁকেই জিজ্ঞেস করে দেখুন, প্রথমে আমি যেতে এবং আসতে চাইনি। পরে বিবেকের অনুশোচনায় আসতে বাধ্য হয়েছি। এখন আপনারই আমার বিচার করুন। অন্যায় করে থাকলে যে শাস্তি দেবেন মাথা পেতে নেব। কথা শেষ করে লাইলী মাথা নিচু করে বসে রইল। এমন সময় মাগরিবের আযান শুনতে পেয়ে লাইলী উঠে দাঁড়িয়ে বলল, মাপ করবেন, আমি নামায পড়ব। লাইলীর কথা শুনে সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল। আর লাইলী অযু করার জন্য বাথরুমের দিকে চলে গেল।
সামসুন বলল, মেয়েটা একদম সেকেলে। চল, সবাইকে তো আবার আসতে হবে।
বেয়ারা রহিম বলে উঠল, আপনারা যাই বলুন, আপামনি কিন্তু বড় খাঁটি কথা বলেছেন।
সোহানা বেগম ধমকে উঠলেন, নে হয়েছে, তোকে আর লেকচার দিতে হবে না।
মাগরিবের নামায পড়ে লাইলী সোহানা বেগমের কাছে গিয়ে বলল, খালাআম্মা, ড্রাইভারকে দিয়ে আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিন।
সোহানা বেগম বললেন, কেন মা, তোমার কী কোন অসুবিধে হচ্ছে? তোমাকে তো বলেছি, আজ সন্ধ্যার পর রুবীনার বার্থডে উৎসব হবে। ওর অনেক বন্ধু-বান্ধবী আসবে, তুমি ওদের সঙ্গে একটু আনন্দ করবে না?
লাইলী বলল, আমি অন্য সমাজের মেয়ে। আপনাদের এখানে যারা আসবেন, তারা হয়তো আমাকে পছন্দ করবেন না। তাই ভয় হচ্ছে, আমার জন্যে আপনারা অপমানিত হতে পারেন।
পাগলী মেয়ে, ওসব আজেবাজে চিন্তা করো না। কে কি ভাববে অত চিন্তার কি আছে? আর তোমার জন্য আমরাই বা অপমান হতে যাব কেন? তা ছাড়া হঠাৎ যদি তেমন কিছু ঘটেও যায়, তা হলে তুমি তোমার জ্ঞানের দ্বারা তা কভার দিতে পারবে বলে আমি মনে করি। ঐসব চিন্তা বাদ দিয়ে তুমি রুবীনার কাছে যাও মা।
রুবীনা ছোট বলে মা ও ভাই এর খুব আদর পায়। সে খুব আলট্টা মর্ডান। সব সময় নিত্য নূতন পোশাক পরে নিজেকে বড়লোকের সুন্দরী মেয়ে বলে জাহির করে এবং রূপের আগুনে ছেলেদের আকর্ষণ করে বেড়ানকে গর্ব বলে মনে করে। ছাত্রী হিসাবে মোটামুটি ভালো। তবে রূপ চর্চার চেয়ে যদি পড়াশোনায় মন দিত, তা হলে অনেক ভালো রেজাল্ট করতে পারত। তবু এখনও তরুণীর শেষ পর্যায়ে অর্থাৎ যৌবন ছুঁইছুঁই করছে। সব সময় স্কুলের ও পাড়ার দু’ একজন বয়ফ্রেণ্ডের সঙ্গে সময় কাটায়। তাদের মধ্যে করিম নামে বড়লোকের একটা ছেলের সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করতে শুরু করেছে।
অবশ্য এই ব্যাপারটা তার মা অথবা ভাই কেউ জানে না।
রুবীনা প্রথম থেকে লাইলীকে ভালো চোখে দেখতে পারেনি। সেটা লাইলী কিছুটা আঁচ করতে পেরেছে। তাই সোহানা বেগম যখন লাইলীকে তার কাছে যেতে বললেন তখন তার মন তাতে সায় দিল না। সে ধীরে ধীরে বাইরে এসে ফুল বাগানের দিকে বারান্দায় একটা চেয়ারে বসে বিকেলের কথাগুলো ভাবতে লাগল।
এর মধ্যে দু’একজন করে আসতে শুরু করেছে। অনেকের বাবা-মা ও আসছেন। রুবীনা ছেলে মেয়েদের আর সেলিম বড়দের অভ্যর্থনা করতে লাগল। রাত্রি আটটায়ে কেক কাটা দিয়ে উৎসব শুরু হল। নাস্তার পর চা, কফি, কোকো, ফান্টা ও সেভেন আপ যার যার ইচ্ছামত পরিবেশন করা হল। অনেকে রুবীনাকে কিছু গাইবার জন্য অনুরোধ করল। সে একটা রবীন্দ্র সঙ্গীত ও একটা আধুনিক গান গাইল। তার গান শুনে সকলে খুশি হয়ে হাততালি দিল। হঠাৎ রেহানা দাঁড়িয়ে বলল, এবার সেলিম ভাই আপনাদের একটা গান শুনাবে। তারপর লাইলীকে গাওয়ার জন্য সকলের তরফ থেকে আমি প্রস্তাব দিচ্ছি।
কথাটা শুনে লাইলী চমকে উঠল। জীবনে সে কোনোদিন গান বাজনা করে নি। এখন সে কি করবে ভাবতে লাগল।
সেলিম একটা আধুনিক গান গাইল। তার গলা খুব ভালো। সেলিমের গান শুনে সকলে মোহিত হয়ে গেল। লাইলী চিন্তার মধ্যে থাকলেও সেলিমের গলা শুনে খুব আশ্চর্য হল। সেলিম এত ভালো গান গাইতে পারে এটা যেন তার কল্পনার বাইরে। হাত তালিতে ঘর গম গম করে উঠল। এখন লাইলী আবার চিন্তিত হয়ে পড়ল।
সেলিম লাইলীর সব কিছু লক্ষ্য করছিল। হাত তালি থামিয়ে দিয়ে সে বলল, এবার রেহানা আমাদের পিয়ানো বাজিয়ে শোনাবে।
সালমা বলে উঠল, কিন্তু এবার তো লাইলীবানুর পালা।
সেলিম বলল, ঠিক আছে, রেহানা আগে পিয়ানো বাজিয়ে শোনাক।
রেহানা অনেক কষ্টে রাগটা সামলে নিয়ে নিজেকে সংযত করে পিয়ানো বাজাল। অদ্ভুত সে বাজনা। তার পিয়ানো বাজনা শুনে সকলে স্তব্ধ হয়ে গেল। লাইলীর মনে হল, সেলিমের গলার থেকে বাজনাটা আরো অনেক শ্রুতিমধুর। সে মনে মনে রেহানাকে ধন্যবাদ জানাল। রেহানা পিয়ানো বাজিয়ে সকলের অকুণ্ঠ প্রশংসা কুড়াল। শেষে রেহানা লাইলীর কাছে গিয়ে তার হাত ধরে দাঁড় করিয়ে সকলের দিকে চেয়ে বলল, এনাকে আপনারা অনেকে চেনেন না। ইনি আমাদের কাছে আজ নূতন অতিথি। ইসলামিক হিষ্টির অনার্সের ছাত্রী। আশা করি, কিছু শুনিয়ে আমাদের সকলকে আনন্দ দান করবেন। রেহানা কথা শেষ করে চেয়ারে গিয়ে বসে ভাবল, মনের মত অপমান করার সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছি।