ভালো আছি বলে সালমা চুপ করে রইল। সেও বড়লোকের মেয়ে।
রেহানা চা খেতে খেতে সেলিমকে বলল, সালমাকে নিয়ে আজ আমি তোমার সঙ্গে ব্যাডমিন্টন খেলব, দেখি হারাতে পারি কি না? সালমা খুব ভালো খেলে। যারা এসেছে তারা সবাই বড়লোকের ছেলেমেয়ে। মেয়েরা কেউ সালওয়ার কামিজ, কেউ শাড়ী, আবার কেউ ফুলপ্যান্টের উপর পাঞ্জাবী পরে এসেছে। তাদের পায়ে ডিস্কো ও পেন্সিল হীল জুতো। সেলিম মৃদু হেসে বন্ধু রেজাউলকে জুটি করে খেলতে নামল।
রেহানা স্যাণ্ডো ব্লাউজ ও শাড়ী পরেছে। সে শাড়ীটা ভালভাবে সেঁটে নিল। আর সালমা টাইটফিট সালওয়ার কামিজ পরেছে। সরু ওড়নাটা বুকের মাঝখান দিয়ে এঁটে পিছনের দিকে বেঁধে নিল। তাদের ভরাট যৌবন পুষ্ট শরীর খেলার ছন্দে উত্তাল তরঙ্গের মত ঢেউ খেলতে লাগল। ছেলেদের মধ্যে অনেকে খেলা দেখা বাদ দিয়ে তাদের দুজনের যৌবনের উত্তাল তরঙ্গ দেখতে লাগল।
এতক্ষণ লাইলী ঘরের ভিতরে সোহানা বেগমের কাছে ছিল। খেলা শুরু হতে তিনি বললেন, যাও না, ওদের খেলা দেখ গিয়ে।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও লাইলী এক পা দু’পা করে বারান্দায় গিয়ে দুটি মেয়েকে দুটো ছেলের ঐভাবে খেলতে দেখে লজ্জা পেয়ে সরে এসে একটা চেয়ারে বসে রইল।
রেহানা ও সালমা দুজনেই পটু। তার উপর আজ প্রতিজ্ঞা করে নেমেছে, সেলিমকে হারাবেই। সেলিম অপটু রেজাউলকে নিয়ে ওদের বিরুদ্ধে খেলতে হীমসীম খেয়ে যাচ্ছে। হার্ড কনটেন্ট হওয়ার পর শেষ পর্যন্ত সেলিমরা তিন পয়েন্ট জিতে গেল। তারা সকলে খুব ক্লান্ত হয়ে বারান্দায় ফ্যানের নিচে বিশ্রাম নিতে এসে লাইলীকে দেখে অবাক হয়ে গেল। যারা তাকে এর আগে দেখেনি তারা তাকে অস্পরী মনে করে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে রইল। সামসুনের সঙ্গে লাইলীর ওবেলা পরিচয় হয়েছিল। সে তার কাছে এসে বলল, চলুন আমরাও একটু খেলে আসি।
লাইলী বলল, মাপ করবেন, আমি ওসব খেলা জানি না।
কথাটা সেলিম, রেহানা ও অন্য সবাই শুনতে পেল। একমাত্র লাইলী সাদামাঠা পোশাক পরে শালীনতা বজায় রেখেছে। তাকে এই পোশাকে এদের সকলের চেয়ে সুন্দরী দেখাচ্ছে। সব ছেলে মেয়ে তার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে দেখছিল। লাইলীর ওসব খেলা জানি না কথাটা শুনতে পেয়ে সকলে তার দিকে সরাসরি তাকাল।
রেহানা প্রথম থেকে লাইলীর রূপ দেখে হিংসায় জ্বলছিল। তার উপর সেলিমের সঙ্গে ওবেলা এসে এতক্ষণ ঘরেই ছিল বুঝতে পেরে মনে মনে ইর্ষায় ও রাগে গুমরাচ্ছিল। তাকে দেখার আগে পর্যন্ত রেহানার ধারণা ছিল, তার মত সুন্দরী তাদের সোসাইটিতে কেউ নেই। এতদিন সে মনে করত সেলিম তাকে ভালোবাসে, কিন্তু আজ লাইলীকে দেখে তার ধারণা মিথ্যা বলে মনে হল। কেন কি জানি তার ভিতর থেকে কে যেন বলল, এর কাছে তুমি হেরে যাবে। হিংসার বশবর্তী হয়ে তার কথায় খেই ধরে বিদ্রুপ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, তা হলে কি খেলা আপনি জানেন?
লাইলী কয়েক সেকেণ্ড রেহানার দিকে চেয়ে থেকে বলল, আমি কি খেলা জানি
জানি, তা আপনাদের জানা দরকার আছে বলে মনে করি না। তবে আমার মনে হয়, ঐ রকম বিদেশী খেলা আমাদের দেশের মেয়েদের কোনো প্রয়োজন নেই।
সালমা তাড়াতাড়ি কটাক্ষ করে বলে উঠল, তা হলে স্বদেশী কি খেলা আমাদের খেলা উচিত বলে দিলে বাধিত হব।
লাইলী বলল, দেখুন, আমি আপনাদের সমাজের মেয়ে নই। আপনারা কি খেলবেন না খেলবেন, সে বিষয়ে আমি উপদেশ দিতেও আসিনি এবং সে সব সম্বন্ধে আমার কোন জ্ঞানও নেই। আপনাদের একজন আমাকে খেলতে ডেকেছেন। তার উত্তরে আমি শুধু বলেছি ওসব খেলতে জানি না। এর মধ্যে যদি আপনারা জেলাস মনোভাব নিয়ে আমাকে আক্রমণ করেন, তা হলে আমি অপরাগ। কারণ আপনাদের সকলের যুক্তির কাছে আমি একা নিরূপায়? তবে আমার মনে হয়, বড় ছেলে মেয়েরা এক সঙ্গে খেলাধুলা না করে আলাদাভাবে অর্থাৎ ছেলেরা ছেলেদের সঙ্গে আর মেয়েরা মেয়েদের সঙ্গে খেললে, খেলাধুলার উদ্দেশ্য নিশ্চয় নষ্ট হবে না।
লাইলীর কথা শুনে কেউ কোনো উত্তর দিতে না পেরে চুপ করে গেল।
সেমীনা ও রোজীনা টেবিল টেনিস খেলা শেষ করে এসে লাইলীর কথা শুনছিল। সেমিনা নীরবতা ভঙ্গ করে বলে উঠল, তা হলে আপনি ছেলেদের সঙ্গে ভার্সিটিতে পড়ছেন কেন?
লাইলী স্মীত হাস্যে তার দিকে চেয়ে বলল, নিরূপায় হয়ে। যদি আমাদের দেশে মেয়েদের জন্য আলাদা ইউনিভার্সিটি থাকতো, তা হলে আমি কো-এডুকেশনে পড়তাম না।
এবার রেহানা জিজ্ঞেস করল, তা না হয় হল, কিন্তু আপনি গার্ল ফ্রেণ্ডের সঙ্গে না বেড়িয়ে বয় ফ্রেন্ডের সঙ্গে বেড়ান কেন?
খোঁটাটা লাইলী ভালভাবে অনুভব করল। কোনো রকম দ্বিরুক্তি না করে জওয়াব দিল, আমার কোনো বয় ফ্রেণ্ড নেই। আর আমি কোনদিন কোন ছেলের সঙ্গে ঘুরেও বেড়ায়নি?
রেহানা একটু রাগের সঙ্গে আবার জিজ্ঞেস করল, সেদিন সেলিম ভাই-এর সঙ্গে গাড়িতে করে তা হলে কোথায় গিয়েছিলেন? আর আজই বা তার সঙ্গে এ বাড়িতে এসেছেন কেন? সেই জন্য লোকে বলে, কেউ নিজের দোষ নিজে দেখতে পায় না, শুধু অপরের দোষ দেখতে পায়।
এই কথায় সেলিম ও সোহানা বেগম ছাড়া সবাই হো হো করে হেসে উঠল।
সোহানা বেগম রহিমের হাতে চা-নাস্তা দিয়ে সঙ্গে এসে তাদের কথা শুনছিলেন। ব্যাপারটা ক্রমশঃ ঝগড়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দেখে বললেন, তোমাদের একি ব্যাপার বলতো? একটা মেয়ে অতিথি হয়ে এ বাড়িতে এসেছে। তাকে তোমরা যা তা প্রশ্ন করে ব্রিত করে তুলছে। তা ছাড়া কারও ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে সবাইর সামনে এভাবে প্রশ্ন করা খুবই অন্যায়। এখন ওসব কথা বাদ দিয়ে কে কি খাবে নাও। এরপর কেউ আর কোনো কথা বলতে সাহস করল না। চুপ চাপ কেউ কোকো কোলা, কেউ চা পান করতে লাগল।