লাইলী এতক্ষণ তার দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়েছিল। দৃষ্টিটা নামিয়ে নিয়ে বলল, সে খবর আমার অন্তর্যামী জানেন। আপনি বসুন, আমি এক্ষুনি আসছি। তারপর দরজার বাইরে এসে রহিমা ভাবিকে দেখে লজ্জা পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।
সে তারই অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে দুজনের কথা শুনছিল। বলল, কথায় বলে, যে যাকে ধায় তাকে সে পায়। কথাটা এতদিন শুনে এসেছি, আজ প্রত্যক্ষ করলাম। তা। যাচ্ছ কোথায়? কি দিয়ে আপ্যায়ন করাবে শুনি?
লাইলী প্রথমে লজ্জায় কথা বলতে পারল না। তারপর বলল, তুমিই বল না ভাবি।
বারে তোমার প্রিয়তমকে কি খাওয়াবে, সে কথা আমি কি করে বলব? বাজারে যাওয়ার তো কোনো লোক নেই। তোমার স্টকে যদি কিছু না থাকে, তবে আমার কাছ থেকে ধার নিতে পার।
তার দরকার নেই বলে লাইলী উপরে মায়ের কাছে গিয়ে বলল, জান আম্মা, ভার্সিটির সেই ছেলেটা এসেছে।
হামিদা বানু বললেন, কোথায় বসিয়েছিস তাকে?
নিচে ড্রইংরুমে, তুমি একটু চা কর না আম্মা।
হ্যাঁরে, অত বড়লোকের ছেলেকে শুধু চা দিবি?
আমরাতো আর বড়লোক নই, গরিব জেনেই এসেছেন। একটা ডিম সিদ্ধ করে আলমারী থেকে কয়েকটা বিস্কুট প্লেটে নিয়ে চায়ের কাপসহ এসে ঘরে ঢুকল। সেগুলো টেবিলের উপর রেখে একগ্লাস পানি নিয়ে এসে বলল, অনেকক্ষণ একা একা বসিয়ে রাখলাম, সে জন্য ক্ষমা চাইছি।
সেলিম বলল, এসবের কিছু দরকার ছিল না। তুমি তো আমার কথা না শুনে চলে গেলে। একটা কথা বলব, শুনবে? আমার সঙ্গে একটু বাইরে যাবে?
লাইলী কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থেকে বলল, আগে এগুলো খেয়ে নিন।
তোমার চা কোথায়?
আমি একটু আগে খেয়েছি।
সেলিম ডিমটা খেয়ে চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, আমার কথার উত্তর দিলে না যে?
আপনার সাথে যাব, সে তো আমার পরম সৌভাগ্য। কিন্তু বলে লাইলী চুপ করে মেঝের দিকে চেয়ে রইল।
কিন্তু আবার কি? তোমার কোনো কিন্তু আমি শুনব না।
দেখুন, আপনার সঙ্গে যেতে আমি মনেপ্রাণে চাই। কিন্তু আল্লাহপাক যুবক যুবতীকে এভাবে যেতে নিষেধ করেছেন। রাসূল (দঃ) পবিত্র হাদিসে বলেছেন-”যদি কোনো লোক কোনো স্ত্রীলোকের সহিত নির্জনে থাকে, তাহাদের মধ্যে তৃতীয়জন থাকে শয়তান।”(১) আল্লাহপাক সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা। তাঁর সৃষ্টির মধ্যে মানুষই সর্বশ্রেষ্ঠ। অতএব সেই সৃষ্টির সেরা মানুষের উচিত সষ্টার হুকুম মেনে চলা।
সেলিম লাইলীর মুখের দিয়ে চেয়ে তার কথাগুলো হৃদয়ঙ্গম করে বলল, তোমার কথা হয়তো ঠিক; কিন্তু আমরা ছেলে মানুষ। একটু আধটু অন্যায় করলে তা তিনি নিজ গুণে ক্ষমা করে দেবেন। শুনেছি, তিনি অসীম ক্ষমাশীল ও করুণাময়। বাবা-মা
সেই গুণের কিঞ্চিতের বঞ্চিত পেয়ে তাদের ছেলেমেয়েদের কত রকম অন্যায় ক্ষমা করে দেয়।
আপনি ঠিক বলেছেন, কিন্তু ছেলেমেয়েরা বড় ও শিক্ষিত হয়ে যদি পিতা-মাতার আদেশ অমান্য করে তখন তো ক্ষমার কোনো প্রশ্নই উঠে না। আর ওঁরা ক্ষমা করলেও নিজেদের বিবেকের কাছে চিরকাল অপরাধী হয়ে থাকে। এখন আপনিই বলুন, আমরা শিশু, না শিক্ষিত যুবক-যুবতী? আমরা জ্ঞানী হয়ে যদি অন্যায় করি, তবে কী তিনি বিনা শাস্তিতে তা ক্ষমা করবেন?
সেলিম বলল, তোমাকে নিয়ে বেড়াতে গেলে আল্লাহ যত শাস্তি দেন না কেন, তাতে আমার কোন আপত্তি নেই।
লাইলী বলল, শাস্তি অবশ্য দুজনেরই হবে। আমার হয় হোক কিন্তু আমার জন্য আপনি পাবেন, তা আমি হতে দিতে পারি না।
আচ্ছা, তোমরা কি কোনো কাজ আল্লাহ ও রাসূলের হুকুমের বাইরে কর না?
আল্লাহপাকের প্রিয় বান্দারা তা করে থাকেন। আমরা তাদের পায়ের ধুলোর মোগ্যও নই। তবে যতটা পারি মেনে চলার চেষ্টা করি।
তোমার কাছ থেকে আজ অনেক জ্ঞান পেলাম। আমাদের সোসাইটির অনেক মেয়ের সঙ্গে বেড়িয়েছি। সত্যি বলতে কি, তাদের সঙ্গে বেড়িয়ে মনে শান্তি পাইনি। কোথায় যেন খচ খচ করে বিঁধতে। তোমার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকে মনের সেই খচখচানিটা আর নেই। মনের ভিতর থেকে কে যেন বলে এই সেই মেয়ে, যাকে তুমি খুঁজে বেড়াচ্ছ। তোমার সংগে বেড়িয়ে যে আনন্দ পেতাম, এখন মনে হচ্ছে তার থেকে অনেক বেশি শান্তি পেলাম। পড়তে ভালো লাগছিল না। তোমার কথা মনে হতে ভাবলাম, তোমাকে নিয়ে একটু বেড়ালে মনটা ফ্রেশ হয়ে যাবে। তাই এসেছি। তোমারও তো সামনে পরীক্ষা। অনেক সময় নষ্ট করলাম এখন চলি তা হলে।
সেলিম চলে যেতে উদ্যত হলে লাইলী বলল, যাবেন না, বসুন। আমার যতই পড়ার ক্ষতি হোক, আমি কিছু মনে করব না। আপনি তাড়াতাড়ি চলে গেলে বরং আমি মনে খুব কষ্ট পাব। আর পড়াশুনাও একদম করতে পারব না। আর একটু অপেক্ষা করুন। আমি এক্ষুণি আসছি বলে সে ঘর থেকে বেরিয়ে ভাবির ঘরে গেল।
রহিমা বলল, তোমাকে ধন্যবাদ না দিয়ে পারছি না। তুমি যে কি করে সেলিম সাহেবের আমন্ত্রণ ডিনাই করতে পারলে ভেবে পাচ্ছি না? আমি হলে তা বর্তে যেতাম। কি চিন্তা করলে? যাবে নাকি?
তুমিই বল না ভাবি? আমার মাথায় তো কিছুই আসছে না।
ওমা, আমি কি বলব? তুমি আমার চেয়ে কত জ্ঞানী? তবে আমার মতে, যার মধ্যে সবকিছু বিলীন করে দিয়েছ এবং যাকে স্বামী বলে মনে প্রাণে মেনে নিয়েছ, তার সন্তুষ্টির জন্য একটু বেড়াতে গেলে পাপ হবে না। আর যদি তা হয়, আল্লাহপাকের কাছে ক্ষমা চাইলে নিশ্চয় ক্ষমা করে দেবেন।