রেজাউল কিছু বুঝতে না পেরে বলল, হেঁয়ালি রেখে আসল কথা বল।
বলব দোস্ত বলব, তবে এখন নয়। আগে ব্যথাটা সামলাতে দে, তারপর বুঝলি?
ঠিক আছে তাই বলিস। এখন যে বইটার জন্য এসেছিলি সেটা নিয়ে চল, ওরা সবাই অপেক্ষা করছে।
সেলিম আলমারী থেকে স্ট্যাটিসটিকস এর একটা বই নিয়ে দু’জনে ক্লাসে রওয়ানা দিল। সেদিন লেকচারার এ্যাবসেন্ট থাকায় ওরা কয়েকজন ক্লাসে বসে গল্প করছিল। কবির নামে সেলিমের আর এক বন্ধু কাছে এসে বলল, এই অঙ্কের উত্তরটা মিলছে না কেন বলতে পারিস?
তার প্রশ্ন শুনে আরও কয়েকজন ছেলে এসে অঙ্কটা দেখে বলল, আমরাও পারিনি।
সেলিম ততক্ষণে অঙ্কটা কষতে আরম্ভ করে দিয়েছে। অল্পক্ষণের মধ্যে অঙ্কটা শেষ করে উত্তর মিলিয়ে দিল।
সকলে দেখে বলল, তুই গোঁজামিল দিয়ে করেছিস। ঐ ফরমূলা আমরা কোথাও পাইনি।
সেলিম বলল, অমুক বইতে ফরমুলাটা আছে। দাঁড়া, বইটা লাইব্রেরী থেকে নিয়ে আসি। বইটা তাড়াতাড়ি করে আনার জন্য তিনতলা থেকে নামার সময় নিচের তলার সিঁড়ির শেষ ধাপে লাইলীর সঙ্গে ধাক্কা লাগে। রেজাউলের সঙ্গে বইটা নিয়ে এসে ক্লাসের সবাইকে ফরমুলাটা দেখল।
সেলিম স্ট্যাটিসটিকস-এ অনার্স পড়ে। এটা তার ফাইন্যাল ইয়ার। ক্লাসের মধ্যে সেরা ছাত্র। বিরাট বড়লোকের ছেলে। গুলশানে নিজেদের বাড়ি। তাদের কয়েকটা বীজনেস। তারা দুই ভাই এক বোন। সেলিমই বড়। দুবছরের ছোট আরিফ। বোন রুবীনা সকলের ছোট। সে ক্লাস টেনে পড়ে। ওদের ফ্যামিলী খুব আল্টমডার্ণ। শুধু নামে মুসলমান। ধর্মের আইন-কানুন মেনে চলা তো দূরের কথা, ধর্ম কি জিনিষ তাই হয়তো জানে না। পিতা হাসেম সাহেব গত বছর থাম্বোসীসে মারা গেছেন। তিনি বীজনেস মেনেজমেন্টে বিদেশ থেকে ডিগ্ৰী নিয়ে এসে প্রথমে একটা কটন মিলের ম্যানেজার ছিলেন। হাসেম সাহেব একজন সুদৰ্শন পুরুষ। কর্মদক্ষতায় মালিকের প্ৰিয়পাত্র হয়ে তার একমাত্র কনাকে বিয়ে করে ভাগ্যের পরিবর্তন করেন। পরে নিজের চেষ্টায় আরও দু-তিন রকমের ব্যবসা করে উন্নতির চরম শিখরে উঠেন। বন্ধু বান্ধবদের তিনি বলতেন, ধর্ম মেনে চললে আর্থিক উন্নতি করা যায় না। জীবনে আর্থিক উন্নতি করতে হলে ধর্ম ও মৃত্যু চিন্তাকে দূরে সরিয়ে রাখতে হয়। অর্থাৎ ভুলে যেতে হবে। আর আল্লাহকে পেতে হলে মৃত্যুকে সামনে রেখে ধর্মের আইন মেনে চলতে হবে। তিনি আরও বলতেন, যৌবনে উপার্জন কর এবং ভোগ কর। তারপর বার্ধক্যে ধর্মের কাজ কর। তার এই মতবাদ যে ভুল, তিনি নিজেই তার প্ৰমাণ। প্রথমটায় কৃতকাৰ্য হলেও অকালে মৃত্যু হওয়ায় দ্বিতীয়টায় ফেল করেন।
সেলিমের যখন ইন্টারমিডিয়েটের সেকেণ্ড ইয়ার তখন আরিফ ম্যাট্রিকে সব বিষয়ে লেটার পেয়ে পাশ করল। পরীক্ষার পর কিছুদিন তবলীগ জামাতের সঙ্গে ঘুরে নিয়মিত নামায পড়তে লাগল। এইসব দেখে পিতা হাসেম সাহেব মাঝে মাঝে রাগারাগী করতেন।
কিন্তু পরীক্ষার রেজাল্ট আউট হওয়ার পর যখন সে জানাল, মাদ্রাসায় ভর্তি হবে তখন তিনি রাগে ফেটে পড়লেন। ভীষণ বকাবিকি করার পর বললেন, ঐ ফকিরি বিদ্যা পড়ে ভবিষ্যতে পেটে ভাত জুটবে না। সব সময় পরের দয়ার উপর নির্ভর করে থাকতে হবে। ওসব খেয়াল ছেড়ে দাও, আর এখন তোমাকে নামাযসব বুড়ো বয়সের ব্যাপার। মা সোহানা বেগমও অনেক করে বোঝালেন। কিন্তু কারুর কথায় কিছু হল না। একদিন সকালে আরিফকে দেখতে না পেয়ে সবাই অবাক হল। কারণ সে প্রতিদিন খুব ভোরে উঠে নামায পড়ে। আজ যখন বেলা আটটা বেজে যেতেও নাস্তার টেবিলে এল না। তখন সোহানা বেগম বললেন, দেখতো রুবীনা, তোর ছোটদা উঠেছে কিনা।
রুবীনা আরিফের ঘরে ঢুকে তাকে দেখতে পেল না। পড়ার টেবিলের উপর পেপার ওয়েট চাপা দেওয়া একটা কাগজের উপর দৃষ্টি পড়তে তাড়াতাড়ি করে কাগজটা হাতে নিয়ে পড়তে লাগল—
মা ও বাবা, তোমাদের দু’জনের পবিত্ৰ কদমে রইল হাজার হাজার সালাম। আমার মন আল্লাহ, রাসূল ও ধর্ম সম্বন্ধে জানার জন্য বড় অস্থির হয়ে পড়েছে। তোমরা আমাদেরকে সেই অমৃতের সন্ধান দাওনি। আল্লাহ পাকের রহমতে আমি সেই পথের সন্ধান পেয়েছি। তাই তোমাদের অজান্তে সেই অমৃত পাওয়ার জন্য বেরিয়ে পড়লাম। তোমাদের কথামত চলার অনেক চেষ্টা করলাম; কিন্তু মনকে কিছুতেই দমিয়ে রাখতে না পেরে চলে যেতে বাধ্য হলাম। তোমরা দোয়া কর-আল্লাহপাক যেন আমার মনের বাসনা পূরণ করেন। তোমরা আমার খোঁজ করবে না। কারণ তাতে কোনো ফল পাবে না।
ইতি
তোমাদের অবাধ্য সন্তান
আরিফ
পড়া শেষ করে রুবীনা ছুটে এসে কাগজটা বাবার হাতে দিয়ে বলল, ছোটদা চলে গেছে।
হাসেম সাহেব পড়ে রাগে কথা বলতে পারলেন না। কাগজটা স্ত্রীর হাতে দিয়ে কিছুক্ষণ চুপ-চাপ বসে থেকে উঠে ফোনের কাছে গিয়ে কয়েক জায়গায় ফোন করলেন। পরপর কয়েকদিন কাগজে আরিফের ফটো ছাপিয়ে সহৃদয় ব্যক্তিদের অনুসন্ধান জানাবার অনুরোধ করে বিজ্ঞাপন দিলেন। তারপর বেশ কিছুদিন খোঁজাখুঁজি করলেন। শেষে কোনো সংবাদ না পেয়ে হাল ছেড়ে দেন। এই ঘটনার দুবছর পর হাসেম সাহেব মারা গেলেন।
স্ত্রী সোহানা বেগম ব্যবসার সব কিছু বাড়িতে বসে দেখাশুনা করতে লাগলেন। তিনি গ্র্যাজুয়েট। সাতজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী নিয়ে একটা বোর্ড গঠন করে তাদের দ্বারা ব্যবসা চালাতে লাগলেন। প্রত্যেক দিন ম্যানেজার বাড়িতে এসে খাতা-পত্ৰ দেখিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে যান। স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি সেলিমকে সবকিছু দেখাশোনা করতে বলেছিলেন। সে রাজি হয় নি। ভীষণ জেদী ছেলে। বাপের মত এক রেখা। বলল, আগে পড়াশুনা শেষ করি, তারপর।