লাইলী হাতের বইটা নিয়ে পড়ার চেষ্টা করল। কিন্তু লেখার পরিবর্তে মনের
পর্দায় সেলিমের ছবি ভেসে উঠতে তন্ময় হয়ে তার কথা চিন্তা করতে লাগ
রহিমা নিজের রুমে এসে লাইলীর কথা ভাবছিল। কিছুক্ষণের মধ্যে জলিল সাহেব অফিস থেকে ফিরলেন। সালাম বিনিময়ের পর রহিমা স্বামীর জামা-কাপড় আলনায় রেখে লুংগী এগিয়ে দিয়ে বলল, তুমি হাত মুখ ধুয়ে নাও, আমি নাস্তা নিয়ে আসি। এদিকে সাদেক ও ফিরোজা ঘুম থেকে উঠে পড়ছে। সকলে মিলে আগে আসরের নামায পড়ল। সাদেক এই বয়স থেকেই নিয়মিত নামায পড়ে। চার বছরের মেয়ে ফিরোজাও মায়ের সঙ্গে শুরু করে দেয়।
নাস্তা খাওয়ার সময় রহিমা বলল, তুমি যে লাইলীর জন্য তোমার কলিগকে পছন্দ করেছ, এদিকে তোমার বোন তো আর একজনকে মন দিয়ে বসে আছে।
জলিল সাহেব স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে কথাটা বোঝার চেষ্টা করে সফল হতে পেরে বলল, ব্যাপারটা খুলে বল, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।
এতে না বোঝার কি আছে? সেদিন সেলিম নামে যে ছেলেটাকে দাওয়াত করে খাওয়ানো হলো, সে তো লাইলীর জান ও ইজ্জৎ বাঁচিয়েছে। তার অনেক আগেও নাকি কি একটা ঘটনায় দুজন দুজনের প্রতি আকৃষ্ট হয়। শেষে ঐ দুঘর্টনার মাধ্যমে তা দৃঢ় হয়। এই তো কিছুক্ষণ আগে তার সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলছিলাম। আমার কাছে তোমার কলিগের কথা শুনে আমাকে সব খুলে বলেছে। স্বামীকে চুপ করে নাস্তা খেতে দেখে জিজ্ঞেস করল, কিছু বলছ না যে?
কি বলব বল? সবই তকদিরের খেলা। যার সঙ্গে যার জোড়া আল্লাহপাক রেখেছেন, তার সঙ্গে হবেই। সেখানে আমরা হস্তক্ষেপ করে শুধু হয়রানিই হব। যা ঘটবার ঘটবেই। তবে সেলিমদের সম্বন্ধে খোঁজ খবর নেওয়া দরকার। আজকাল বড়লোকের ছেলেদের চেনা বড় মুস্কিল।
.
রেইনী ভ্যাকেসানের জন্য ভার্সিটি দেড়মাস বন্ধ। একটানা কয়েকদিন বৃষ্টি হওয়ার পর আজ সকাল থেকে সোনালী রোদে চারদিক ঝলমল করছে। সোনালী রোদের সংগে লাইলীর মনটাও রঙিন হয়ে উঠল। পড়াশুনায় মন বসাতে পারল না। পনের দিন সেলিমকে দেখেনি। তার মনে হল যেন পনের বছর। কিছুক্ষণ মায়ের কাছে গিয়ে নাস্তা বানাল। তারপর নাস্তা খেয়ে রহিমা ভাবির ঘরে ঢুকল।
জলিল সাহেব একটু আগে অফিসে চলে গেছেন। রহিমা ফিরোজাকে সংগে করে নাস্তা খাচ্ছিল। সাদেক নাস্তা খেয়ে আর সংগে স্কুলে গেছে। লাইলীকে দেখতে পেয়ে বলল, আরে সাত সকালে ননদিনী পড়া ছেড়ে এসেছে দেখছি। এস এস, আমার সঙ্গে একটু নাস্তা খেয়ে নাও।
লাইলী বলল, তুমি খাও, আমি এক্ষুণি খেয়ে এলাম।
বলি ব্যাপার কি? মনের মানুষকে কয়েকদিন দেখতে পাওনি বলে মনটা বুঝি ছটপট করছে?
দেখ ভাবি, ভালো হবে না বলে দিচ্ছি। চোরের মনতো বোচকার দিকে থাকবেই।
আরে ভাই অত চটছো কেন? আমার তো আর ফাঁকা মন নেই যে, বোঁচকার দিকে থাকবে। এই কথা বলে তুমি নিজেই জানিয়ে দিচ্ছ, তোমার মন সেলিম সাহেবকে খুঁজছে।
সেলিমের নাম শুনে লাইলী চুপ হয়ে গেল।
ওমা, সেলিম সাহেবের নাম শুনে একেবারে চুপ করে গেলে যে? বলি ব্যাপারটা যদি গুরুতর পর্যায়ে পৌঁছে থাকে, তা হলে বল, তোমার ভাইয়াকে বলে শুভশ্য শীঘ্রম করার ব্যবস্থা করি।
তুমি থামবে, না আমি চলে যেতে বাধ্য হব? পড়তে ভালো লাগছিল না বলে ওনার কাছে একটু গল্প করতে এলাম, আর উনি কিনা আমাকে তাড়াতে পারলেই বাঁচেন।
ঠিক আছে ভাই ঠিক আছে, আমারই ভুল হয়েছে। তোমাকে তাড়াতে যাব কেন? তুমি গল্প বল, আমি এই চুপ করলাম। তারপর নাস্তার পর্ব শেষ করে হাত-মুখ ধুয়ে এসে রহিমা একটা চেয়ার টেনে লাইলীর কাছে গম্ভীর হয়ে বসল।
লাইলী অভিমানভরা কণ্ঠে বলল, কেউ গোমড়া মুখ করে বাবার মত থাকলে তার সঙ্গে গল্প করা যায় বুঝি?
রহিমা হেসে ফেলে বলল, তুমি বড় ডেঞ্জারাস মেয়ে। কথা বললেও দোষ, আর না বললেও দোষ। কি করব তা হলে তুমিই বলে দাও।
লাইলী এই কথার উত্তর খুঁজে না পেয়ে চুপ করে বসে রইল। ঠিক এমন সময় কলিং বেলটা বিরতি নিয়ে দু’বার বেজে উঠল। কলিং বেল বাজাবার মধ্যেও যেন আভিজাত্য রয়েছে। প্রথমে দু’জনে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। তারপর লাইলী ওঠে গেট খোলার জন্য গেল। দরজার ছিদ্র দিয়ে সেলিমকে দেখে তার মনে আনন্দের শিহরণ খেলে গেল। দরজার এই ছিদ্রটা ভিতরের দিকে একখণ্ড কাঠ দিয়ে ঢাকা থাকে। যখন মেয়েদের গেট খুলতে হয় তখন প্রথমে তারা এই কাঠ সরিয়ে ছিদ্র দিয়ে আগন্তককে দেখে নেয়। সে যদি চেনা লোক হয়, তবে গেট খুলে দেয়, নচেৎ তাকে পরে আসতে বলে।
লাইলী কয়েক সেকেণ্ড দাঁড়িয়ে রইল, তারপর গায়ে মাথায় ভালো করে কাপড় দিয়ে গেট খুলে দিল।
সেলিম লাইলীকে দেখে তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল।
লাইলী বলল, ভিতরে আসুন। কেমন আছেন? সেলিমের দিক থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে দরজার কড়া নেড়ে বলল, এই যে মশায় শুনছেন, এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবেন না। প্লীজ ভিতরে আসুন। লোকে দেখলে কি ভাববে বলুন তো? তা ছাড়া ভাবি জানালা দিয়ে সবকিছু দেখছে।
দরজার কড়া নাড়ার শব্দে সেলিম বাস্তবে ফিরে এল। লাইলীর কথাগুলো শুনে চুপচাপ তার সংগে ড্রইংরুমে এসে বসল।
সেলিমকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে লাইলী বলল, কি ব্যাপার? কোনো কথা বলছেন না কেন?
সেলিম বলল, কি আর বলব বল? তুমি যেভাবে আমার সবকিছু কেড়ে নিয়েছ, তাতে করে না এসে পারলাম না। এই কদিন কিভাবে যে কেটেছে তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। এভাবে এ সময়ে তোমাদের এখানে আসা ঠিক নয় জেনেও চলে এলাম। লোকনিন্দা আমাকে বাধা দিয়ে রাখতে পারে নি। আচ্ছা, তোমার মনে কি কোনো প্রতিক্রিয়া হয় নি?